শচীন টেন্ডুলকার: ভারতরত্ন খেতাবপ্রাপ্ত ক্রিকেটার

বিখ্যাত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে সিংহভাগ ক্রিকেটপ্রেমী সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে মনে করেন। তবে ভারতীয় ও উপমহাদেশীয়দের কাছে কিংবদন্তী ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারই সেরা।

১৯৪৮ সালে স্যার ডন ব্রাডম্যান যখন ক্রিকেট বিশ্ব থেকে অবসর নেন, তখনও শচীনের জন্ম হয়নি। ওই সময় ক্রিকেট বিশ্বে স্যার ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে তুলনা করার সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতেও স্যার ব্রাডম্যানের সমকক্ষ কাউকে পাওয়া যাবে, তা নিয়েও অনেকের সন্দেহ ছিল।

ব্রাডম্যানের অবসরের প্রায় দুই দশকেরও পর ১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল ভারতের মুম্বাই শহরে জন্মগ্রহণ করেন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার (শচীন টেন্ডুলকার)। তার বাবা ছিলেন একজন মারাঠি ঔপন্যাসিক আর মা কাজ করতেন বীমা কোম্পানিতে।

শৈশবে টেনিস খেলার প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল এবং টেনিস খেলোয়াড় হবার স্বপ্নও দেখতেন। কিন্তু ছোটবেলায় তিনি কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির লোক ছিলেন। তাই উচ্ছৃঙ্খলা থেকে তার মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে তার দাদা তাকে বিখ্যাত ক্রিকেট কোচ রমাকান্ত আচরেকরের কাছে নিয়ে যান। কোচের পরামর্শে তিনি ক্রিকেট ঐতিহ্যমন্ডিত শারদাশ্রম বিদ্যামন্দির হাই স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলের পক্ষে বিভিন্ন ক্রিকেট ম্যাচে তিনি অসাধারণ খেলা উপহার দেন।

প্রথম দিকে তিনি একজন ফাস্ট বোলার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮৭ সালে এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশন তাকে প্রত্যাখ্যান করে। ওই বছরই ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ভারত বনাম জিম্বাবুয়ে ম্যাচে একজন ‘বল বয়’ ছিলেন শচীন।

পরে ১৯৮৮ সালে একটি আন্তঃস্কুল ক্রিকেট ম্যাচে শচীন তার বন্ধু বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে ৬৬৪ রানের পার্টনারশিপ গড়ে রেকর্ড করেন। তার শৈল্পিক ক্রিকেট খেলা দেখে সেদিনই সবাই বলাবলি করছিল যে, এই ছেলে একদিন অনেক বড় ক্রিকেটার হবে।

ওই বছরই ১৯৮৮ সালে তিনি মোম্বাইর হয়ে প্রথমবারের মত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অংশ নেন। বিস্ময়করভাবে তিনি তার প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি করে ক্রিকেট বিশ্বকে তার আগমনী বার্তা জানিয়ে দেন। ওই মৌসুমে তিনি সর্বাধিক রান সংগ্রাহক ছিলেন।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার অবদান এতই মনোমুগ্ধকর ছিলো যে, এক মৌসুম খেলেই তিনি জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান। ১৯৮৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেক হয়। যদিও ওই টেস্ট সিরিজে তিনি খুব একটা ভালো স্কোর করতে পারেন নি, তথাপি তার ব্যাটিং শৈলী সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়। ফল স্বরূপ ওই বছরই আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ক্রিকেটেও তার অভিষেক ঘটে।

১৯৯১-৯২ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরকালে টেস্টে বাঘা বাঘা বোলারদের বিপক্ষে খেলে তিনি এক ম্যাচে ১৪৮ রান এবং অপর ম্যাচে ১১৪ রান করেন। ১৯৯৪ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে তিনি ইনিংস অপেনিং করেন। এ ম্যাচে ৪৯ বলে ৮২ রানের এক বিস্ফোরক ইনিংস খেলেন, যা দেখে স্টেডিয়ামের দর্শকরা বিমোহিত হয়ে পড়ে। ওই বছরই তিনি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরি করেন।

১৯৯৮ সালে অস্ট্রেলিয়া ভারত সফরে আসলে ওই সিরিজটি শচীন বনাম ওয়ার্ন সিরিজে পরিণত হয়। ওয়ার্নকে উড়িয়ে দিয়ে তিন সিরিজের ম্যাচে দুটি সেঞ্চুরি করেন শচীন এবং সিরিজ জিতে ভারত।

শচীনের পারফর্মেন্সে মুগ্ধ হয়ে ১৯৯৬ সালে তাকে প্রথমবারের মতো ভারত দলের অধিনাকের দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে তার নেতৃত্বে দল খুব বাজে খেলতে থাকলে ১৯৯৭ সালে তিনি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন। পরে ১৯৯৯ সালে তাকে আবারও অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু এবারও তিনি অধিনায়ক হিসেবে ব্যর্থ হলে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন।

২০০৩ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত ছিল সবচেয়ে ফেভারিট। ওই বিশ্বকাপে শচীনের নৈপুণ্যে ভারত ফাইনালে ওঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভারত অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যায়। তবে মাত্র ১১ ম্যাচে ৬৭৩ রান করে টুর্নাম্যান্ট সেরার পুরস্কারটা নিজের করে নেন শচীন।

মাঝে কিছু দিন বেশ কঠিন সময় যাচ্ছিল শচীনের। তবে ২০০৭ সালের দিকে আবারও ফর্ম ফিরে পান তিনি। ফলস্বরূপ ওই বছরই তিনি টেস্ট ক্রিকেটে ১১হাজার রানকারীদের ক্লাবে ঢুঁকে পড়েন। আর তিনি হয়ে যান ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চ টেস্ট রান সংগ্রাহক।

দুই দশক থেকে ক্রিকেট খেলছেন অথচ তখনও বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন তার কাছে অধরাই রয়ে গেল। অবশেষে সেই অধরা স্বপ্নও ক্রিকেটের বরপুত্র শচীনের কাছে ধরা দিতে বাধ্য হল ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। এই বিশ্বকাপে দুটি সেঞ্চুরিসহ ৪৮২ রান করেন তিনি। আর শ্রীলংকাকে হারিয়ে ভারত বিশ্বকাপ জিতে এবং শচীন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পান।

এরপর থেকে ধীরে ধীরে এই লিটল মাস্টারের ব্যাটে যেন খরা দেখা দিতে শুরু করে। ফলে ২০১৩ সালে সব ধরণের ক্রিকেট থেকে অবসরে চলে যান ক্রিকেটের রাজপুত্র শচীন টেন্ডুলকার।

অবসরের আগে ক্রিকেট বিশ্বের রেকর্ড বইয়ে নানা কীর্তির জন্ম দেন এই কিংবদন্তী ক্রিকেটার। তিনিই প্রথম ওয়ানডে ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করেন। তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার যিনি ৫১টি টেস্ট সেঞ্চুরি ও ৪৯টি ওয়ানডে সেঞ্চুরি নিয়ে সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করেন। তিনি একমাত্র ক্রিকেটার যিনি টেস্টে সর্বাধিক ১৫৯২১ রান এবং ওয়ানডেতে সর্বাধিক ১৮৪২৬ রানসহ সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে সর্বাধিক ৩০ হাজারেরও বেশি রান সংগ্রহ করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। শচীনই একমাত্র ক্রিকেটার যিনি সর্বাধিক ২০০টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন।

শচীনের এই অসাধারণ ক্রিকেট নৈপুণ্যের কারণে অনেকেই ক্রিকেট বিশ্বে ডন ব্রাডম্যানের একক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। টেন্ডুলকারে মুগ্ধ ছিলেন স্বয়ং ডন ব্রাডম্যানও। ডন ব্রাডম্যান বলেছিলেন, একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে এই ভারতীয় (শচীন টেন্ডুলকার) তাকে তার কথা মনে করিয়ে দেয়।

ভারতের ক্রিকেটে তার এই অনবদ্য ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকার ২০১৪ সালে শচীনকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘ভারত রত্ন’ পদকে ভূষিত করে। তিনিই ছিলেন ভারতরত্ন খেতাবপ্রাপ্ত সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয়।

এছাড়া রাজীব গান্ধী খেল রত্ন, অর্জুনা অ্যাওয়ার্ড ও পদ্ম শ্রী পদক পেয়েছেন শচীন। আর তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি এই তিনটি পুরস্কারই জিতেছেন।

অবসরের পর বিভিন্ন মানবসেবামূলক কাজে নিজেকে জড়িত করেন শচীন। তিনি ‘আপনালয়া’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা পরিচালনা করেন এবং প্রতিবছর ২০০ শিশুকে সহায়তা করে আসছেন। এছাড়া ক্যান্সার গবেষণা, শিক্ষা উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে দান সংগঠনগুলোর জন্য তহবিল সংগ্রহ করতেও কাজ করছেন এই ক্রিকেট কিংবদন্তী।

শচীন সম্পর্কে কিছু ব্যতিক্রমী তথ্য-

  • ১৯৮৮ সালে ভারত-পাকিস্তান ওয়ানডে অনুশীলন ম্যাচে একবার বদলি ফিল্ডার হিসেবে পাকিস্তানের হয়ে ভারতের বিপক্ষে ফিল্ডিং করেছিলেন শচীন।
  • শচীন ছিলেন একজন সব্যসাচী ক্রিকেটার, যিনি ব্যাট করতেন ডান হাতে কিন্তু লিখতেন বাম হাতে।
  • ঘুমের মধ্যে হাঁটা ও কথা বলার অভ্যাস ছিল শচীনের।
  • ১৯৯০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো টেস্টে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন। পুরস্কার হিসেবে তাকে দেয়া হয়েছিল একটি শ্যাম্পেইনের বোতল। কিন্তু তার বয়স ১৮ বছরের নীচে হওয়ায় তিনি সেটি ব্যবহার করতে পারেন নি।
  • তিনিই প্রথম ক্রিকেটার, যিনি অতীতে সিভিল এভিয়েশন নিয়ে পড়াশোনা না করেও ভারতীয় বিমান বাহিনী কর্তৃক সম্মানসূচক গ্রুপ-ক্যাপ্টেন পদবী পেয়েছেন।
  • তার সম্মানে ভারতীয় ক্রিকেট থেকে শচীনের পরিহিত ১০ নম্বর জার্সিটা তুলে রাখে ভারতের ক্রিকেট বোর্ড।

শচীনের বিখ্যাত কিছু উক্তি-

“মানুষ তোমার দিকে পাথর (স্টোনস) ছুঁড়বে, তোমার কাজ হলো সে পাথরগুলোকে সফলতার এক একটি ধাপে (মাইলস্টোনস) পরিণত করা”

“স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে কখনও থেমে যাবে না, কারণ স্বপ্নগুলো সত্য হয়”

“আমাদের এক লাফে পঞ্চাশতম তলায় ওঠার চেষ্টা করা উচিত নয়, আমাদের শুরু করতে হবে নীচতলা থেকেই”

 

টাইমস/ইএইচ/জিএস 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জুনের মধ্যেই ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী Mar 29, 2024
img
বাজারে বেড়েছে মাংসের দাম, সবজিতে স্বস্তি Mar 29, 2024
img
বিএনপির ৮০ ভাগ নিগৃহীত নেতাদের তালিকা দিতে হবে : ওবায়দুল কাদের Mar 29, 2024
img
জায়েদ খানের নায়িকা হচ্ছেন টালিউডের পূজা ব্যানার্জি Mar 29, 2024
img
বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর পৌনে ৪ কিলোমিটার দৃশ্যমান Mar 29, 2024
img
আজ ঢাকার বাতাস ‘অস্বাস্থ্যকর’ Mar 29, 2024
img
দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫ Mar 29, 2024
img
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে সর্বোচ্চ রেকর্ড Mar 28, 2024
img
দূষণের কারণে বছরে পৌনে ৩ লাখ বাংলাদেশির মৃত্যু Mar 28, 2024
img
আইএমএফের হিসাবে দেশের রিজার্ভ এখন কত, জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক Mar 28, 2024