এ কে ফজলুল হক। বাংলার ইতিহাসের এক অবিসংবাদিত নেতা। বাংলার একজন প্রখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞ, যিনি কলকাতা ও ঢাকা হাইকোর্টের স্বনামধন্য আইনজীবীদের একজন। তিনি ছিলেন অভিবক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের প্রথম মুসলিম মেয়র।
তিনি ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম আবুল কাশেম ফজলুল হক। তবে তিনি শেরে বাংলা (বাংলার বাঘ) হিসেবেই বেশি পরিচিত।
১৮৮৯ সালে ঢাকা বোর্ড থেকে মেট্রিক পাস করেন। তিনি পরীক্ষায় মুসলিমদের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন। ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক পাস করেন।
১৯০০ সালে আইনজীবী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু। ১৯০১ সালে যোগ দেন বরিশাল আদালতে। ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯১১ সালে চাকরি ছেড়ে কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় নিযুক্ত হন।
১৯১২ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯১৩ সালে ঢাকা থেকে প্রথম বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৫ সালে তিনি পুনঃনির্বাচিত হন। এই দুই মেয়াদে তিনি পরিষদে মোট ১৪৮ বার বক্তব্য দেন, যার মধ্যে ১২৮ বারই মুসলমানদের শিক্ষা নিয়ে কথা বলেছেন। ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত ২১বছর তিনি আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন।
১৯১৯ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব পান। ১৯৩৫ সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে তিনি বেঙ্গল প্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৪১ সালে তিনি পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে এ কে ফজলুল হক ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ উত্থাপন করেন। এ প্রস্তাবের প্রধান দাবি ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পৃথক পৃথক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। এ সভায় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক উপস্থিত ছিলেন।
বাংলার ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর এক বক্তৃতায় তিনি বাংলা ভাষার জন্য পৃথক ‘ল্যাঙ্গুয়েজ একাডেমি’ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংগঠিত আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এসময় পুলিশের হামলায় তিনি আহত হয়েছিলেন।
তিনি কৃষক-শ্রমিক পার্টি নামে স্বতন্ত্র দল গঠন করেন। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ভাসানীর আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং শেরে বাংলার কৃষক-শ্রমিক পার্টিসহ চারটি রাজনৈতিক দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসনে জয়লাভ করে। ৩ এপ্রিল সরকার গঠন করে যুক্তফ্রন্ট। এ সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন শেরে বাংলা।
এ সরকার মাত্র দুই মাস ক্ষমতায় ছিল। এর মধ্যেই তিনি বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের তথ্যমতে, এ সময় পাকিস্তান সরকার আশঙ্কা করে যে শেরে বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন। তাই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫৪ সালের ৩০ মে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাতিল করে দেয়।
১৯৫৫ সালে শেরে কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠন করলে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। পরে ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন শেরে বাংলা।
বাংলার ইতিহাসে শেরে বাংলার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বাংলার মুসলমানদের জন্য অসংখ্য শিক্ষা ও কারগরি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তিনি কলকাতার ঐতিহাসিক ইসলামিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ কলেজে পড়ার সময়ই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনেও তার ভূমিকা রয়েছে। তিনিই প্রথম বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পহেলা বৈশাখে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। জমিদারদের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ ও বাংলার কৃষকদের দুর্দশা লাঘবের লক্ষ্যে তিনি মানি ল্যান্ডার্স অ্যাক্ট (১৯৩৮), বেঙ্গল টিন্যান্সি (সংশোধন) অ্যাক্ট (১৯৩৮) এবং ভূমি সংস্কার আইনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন।
কারমাইকেল হোস্টেল ও কলকাতার বেকার হোস্টেলসহ অসংখ্য ছাত্রাবাসের প্রতিষ্ঠাতা শেরে বাংলা। কলকাতার এই বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষে বঙ্গবন্ধু থাকতেন। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে নাইটহুডসহ বৃটিশদের দেয়া বিভিন্ন খেতাবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অবশেষে ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল বাংলার মহান নেতা এ এক ফজলুল হক মারা যান।
টাইমস/এএইচ/জিএস