ঐতিহ্যবাহী ময়মনসিংহ জিলা স্কুল

ময়মনসিংহ জিলা স্কুল ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভাগে তৎকালীন ভারতের সর্ববৃহৎ জেলা ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রসিদ্ধ হাইস্কুল। এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। কেবল ছেলেদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলের অবস্থান ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে। এই সরকারি স্কুলটিতে ৩য় থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করা হয়।

এন্ট্রান্স তথা ম্যাট্রিক এবং বর্তমানের সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট বা এস এস সি পরীক্ষায় এ স্কুলের ছাত্ররা যথাক্রমে পূর্ববঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে আসছে।

ইতিহাস

ময়মনসিংহ জিলা স্কুল একটি ঐতিহ্যবাহী এবং গৌরবমণ্ডিত বিদ্যাপীঠের নাম। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কালেক্টর এফ.বি ক্যাম্প এর উদ্যোগে ময়মনসিংহে ‘হার্ডিঞ্জ স্কুল’ নামে একটি মিডল ইংলিশ স্কুল স্থাপন করা হয়। কালেক্টরের কাচারি সংলগ্ন একটি লাল ইটের তৈরি একতলা দালানে যাত্রা শুরু করা এ স্কুলে প্রথমে শুধু উচ্চ বিত্তদের সন্তানরা পড়ার সুযোগ পেত। পরবর্তীকালে উড্স ডেসপ্যাচের শিক্ষা নীতির আলোকে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ নভেম্বর হার্ডিঞ্জ স্কুলকে একটি পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি বিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। তখন থেকেই স্কুলটি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল নামে পরিচিতি পায়। 

প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা

অভিজ্ঞ ও দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে উচ্চমানের শিক্ষা প্রদানকারী প্রাচীন বিদ্যালয়গুলির মধ্যে এটি একটি। বালক বিদ্যালয় হলেও ১৯৯০-এর দশক থেকে এখানে পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও শিক্ষকতা করছেন। সরকারি বিদ্যালয় হওয়ায় লেখাপড়ার খরচও এখানে নিতান্ত কম।

১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্কুলে দুটি অধিবেশনে শিক্ষাদান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো হলো সকাল ৭.৩০ থেকে প্রভাতী অধিবেশন এবং দুপুর ১২ থেকে দিবা অধিবেশন। আবার ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি শ্রেণীতে দুটি করে শাখা রয়েছে যথা 'ক' শাখা এবং 'খ' শাখা। প্রতি বছর এই বিদ্যালয়ে তৃতীয় এবং ষষ্ঠ শ্রেণীতে ছাত্র ভর্তি করা হয়।

ভর্তি প্রক্রিয়া

ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে সাধারণত ৩য় ও ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ছাত্র ভর্তি করা হয়। আসন খালি থাকা সাপেক্ষে কোন কোন বছর অন্যান্য শ্রেণীতেও ভর্তি করা হয়। ভর্তি পরীক্ষা দিতে কোন আলাদা যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র যেসব ছাত্র ভর্তি পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে তারাই ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। 

ইউনিফর্ম

১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে স্কুলের ছাত্রদের জন্য সর্বপ্রথম ইউনিফর্ম ড্রেস এবং আইডেনটিটি কার্ড প্রবর্তন করা হয়। বর্তমান ইউনিফর্ম ড্রেস নিম্নরূপ:

  • সাদা শার্ট
  • খাকী রঙের ফুল প্যান্ট
  • সাদা মোজা ও জুতা (কেড্স বা পাম্প শু)
  • নেভী ব্লু সোয়েটার (শীতকালে)
  • নীল রঙের নেমপ্লেট (প্রভাতী শাখা) ও লাল রঙের নেমপ্লেট (দিবা শাখা)
  • বাম পকেটের ওপর স্কুলের মনোগ্রাম

খ্যাতিমান শিক্ষকবৃন্দ

ময়মনসিংহ জিলা স্কুল যেমন আপন মহিমায় ভাস্বর, তেমনি এখানে অনেক খ্যাতিমান ও স্বনামধন্য শিক্ষকও দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রধান শিক্ষকের আসন অলঙ্কৃত করেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর পিতা ভগবান চন্দ্র বসু।

১৮৫৮ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে শিক্ষকতা করার সময়েই ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন প্রথম মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কু্রআন বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। এই কাজের জন্য ব্রাহ্মণরা তাকে ভাই আর মুসলমানরা মৌলানা উপাধি দেন।

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রথম মুসলিম প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জনাব মো. আব্দুস সামাদ। পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষা বোর্ডের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘এক ফালি চাঁদ’ কাব্যগ্রন্থের কবি এস. এম সদরউদ্দিন স্কুলে যোগদান করেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে যোগদান করেন জনাব আবুল আশরাফ মো. আ. শাকুর। পরবর্তীতে তিনি ময়মনসিংহ টি.টি. কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এ ছাড়াও অনেক স্বনামধন্য শিক্ষক এ বিদ্যালয়ে কর্মরত থেকে স্কুলকে স্বমহিমায় উজ্জ্বল করে গেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে মোহছিনা খাতুন দায়িত্ব পালন করছেন।

কৃতি প্রাক্তন শিক্ষার্থীবৃন্দ

ভারতবর্ষের বহু গুণী ব্যক্তিত্ব এ স্কুলে বাল্যকাল অতিবাহিত করেছেন। তার মধ্যে কয়েকজনের নাম পরিচয় নিম্নরূপ:

  • উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী - প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক;
  • স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু - প্রখ্যাত বিজ্ঞানী;
  • আনন্দমোহন বসু - ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাবেক প্রেসিডেন্ট;
  • সৈয়দ নজরুল ইসলাম - বাংলাদেশের ১ম উপ-রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি;
  • নুরুল আমিন - পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী;
  • আবু সাঈদ চৌধুরী - বাংলাদেশের ২য় রাষ্ট্রপতি;
  • মৌলভী হামিদ উদ্দিন আহাম্মদ - ময়মনসিংহের প্রথম মুসলিম গ্রাজুয়েট;
  • আবুল কাসেম ফজলুল হক - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাষ্ট্রচিন্তক;
  • জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা - বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের একজন;
  • আবদুল মোনেম খান -পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর;
  • এম আর আখতার মুকুল - স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের চরমপত্রের পরিচালক, লেখক ও কথক;
  • একেএম মোশাররফ হোসেন - সাবেক জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী;
  • রিয়ার এডমিরাল সুলতান আহমেদ - নৌবাহিনীর প্রাক্তন প্রধান;
  • ড. আশরাফ সিদ্দিকী - প্রখ্যাত লোক বিজ্ঞানী;
  • মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ - ক্রিকেটার, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। 

ফলাফল

দেড়শত বছরের পুরনো ময়মনসিংহ জিলা স্কুল সবসময়ই লেখাপড়াসহ সকল বিষয়েই অঞ্চলের সেরা স্কুল হিসেবে প্রমাণ দিয়ে আসছে। এই স্কুলটি বরাবরই বিভিন্ন পরীক্ষায় সফলতার সাথে ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি পরীক্ষায় স্কুলটির সফলতা বহু বছর ধরেই সেরাদের কাতারে।

ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে প্রতিবছর প্রায় ৯৯-১০০% পাশের হার ও ছাত্রদের একটি বিশাল অংশ জিপিএ-৫ পেয়ে থাকে। সম্প্রতি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল বিভাগের সেরা ডিজিটাল স্কুল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

 

টাইমস/এএস/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জায়েদ খানের নায়িকা হচ্ছেন টালিউডের পূজা ব্যানার্জি Mar 29, 2024
img
বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর পৌনে ৪ কিলোমিটার দৃশ্যমান Mar 29, 2024
img
আজ ঢাকার বাতাস ‘অস্বাস্থ্যকর’ Mar 29, 2024
img
দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫ Mar 29, 2024
img
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে সর্বোচ্চ রেকর্ড Mar 28, 2024
img
দূষণের কারণে বছরে পৌনে ৩ লাখ বাংলাদেশির মৃত্যু Mar 28, 2024
img
আইএমএফের হিসাবে দেশের রিজার্ভ এখন কত, জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক Mar 28, 2024
img
প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির এলিট প্যানেলে সৈকত Mar 28, 2024
img
বিশ্বে প্রতিদিন ১০০ কোটি টন খাবার নষ্ট হয় : জাতিসংঘ Mar 28, 2024
img
জাহাজসহ জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে সরকার অনেক দূর এগিয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী Mar 28, 2024