রাজার স্থান রাজশাহী

রাজশাহী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি জেলা। আর এর প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে পদ্মার তীরে অবস্থিত প্রায় ৯৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিভাগীয় শহর রাজশাহী। রাজশাহী বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শহর। প্রাচীনকালে এই শহরের আশেপাশে বিভিন্ন শাসকরা তাদের রাজধানী গড়ে তুলেছিল। এদের মাঝে লক্ষণৌতি বা লক্ষণাবতী, পুণ্ড্র ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আকর্ষণীয় রেশমীবস্ত্র, আম, লিচু এবং মিষ্টান্ন সামগ্রীর জন্য প্রসিদ্ধ রাজশাহী রেশমনগরী নামেও পরিচিত।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী বিভাগের দক্ষিণ পশ্চিমে রাজশাহী একটি বিস্মৃত জেলা। রাজশাহী জেলার উত্তরে দিনাজপুর ও পশ্চিম বঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুর, পশ্চিমে পশ্চিম বঙ্গের মালদহ জেলা, পূর্বে পাবনা ও বগুড়া জেলা এবং দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত ঘেঁষে পদ্মা নদী প্রবাহিত। এই পদ্মা নদীই রাজশাহীকে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে পৃথক করে রেখেছে।

রাজশাহী নামকরণে উৎস:

রাজশাহী নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেই কয়েক শতাব্দী পূর্বে ফিরে যেতে হয়। এ শহরের প্রাচীন নামটি ছিল মহাকাল গড়। পরে রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়ায় রামপুর-বোয়ালিয়ায়। রামপুর-বোয়ালিয়া শহরের নামকরণ রাজশাহী কী করে হলো তা নিয়ে অনেক মতপার্থক্য রয়েছে।

রামপুর-বোয়ালিয়া থেকে রাজশাহী নামটির উদ্ভব কিভাবে হলো এর সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা নাই। ব্রিটিশ আমলের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসে ও রাজশাহী নামক কোন জনপদ বা স্থানের উল্লেখ নাই। অনেকে মনে করেন, এই জনপদ একদা বহু রাজা, সুলতান আর জমিদার শাসিত ছিল বলে নামকরণ হয়েছে রাজশাহী।

ঐতিহাসিক ব্লকম্যানের মতে, খ্রিষ্টীয় ১৫শ শতকে রাজা গণেশের দখলের সময় থেকে রাজশাহী নামের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু ব্লকম্যানের অভিমত গ্রহণে আপত্তি করে বেভারিজ বলেন, রাজা গণেশের সময় এই নামটির উদ্ভব হলে তার উল্লেখ টোডরমল প্রণীত খাজনা আদায়ের তালিকায় অথবা আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী নামক গ্রন্থে অবশ্যই পাওয়া যেত। ডব্লিউ হান্টারের মতে, নাটোরের রাজা রামজীবনের জমিদারী রাজশাহী নামে পরিচিত ছিল এবং সেই নামই ইংরেজরা গ্রহণ করে এই জেলার নাম দেন রাজশাহী।

অনেকে এসব ব্যাখ্যাকে যথার্থ ইতিহাস মনে না করলেও ঐতিহাসিক সত্য এই যে, নবাব মুর্শিদকুলী খান এই অঞ্চলকে চারুলা রাজশাহী নামে একটি বৃহৎ বিস্তৃতি চাকলা নির্ধারণ করেন। প্রথমে সমগ্র চাকলার রাজস্ব আদায় করতেন হিন্দু রাজ-জমিদার উদয় নারায়ণ। তিনি ছিলেন মুর্শিদ কুলির একান্ত প্রীতিভাজন ব্যক্তি। যে জন্য নবাব তাকে রাজা উপাধি প্রদান করেন।

অনেকের মতে, প্রথম রাজা উদয় নারায়ণের উপর প্রীতি বশত এই চাকলার নাম স্থায়ীভাবে রাজশাহী করেন নবাব মুর্শিদকুলী খান। ১৭১৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খান নাটোরের রামজীবনের নিকট বন্দোবস্ত প্রদানকালে বন্দোবস্তে রাজশাহী নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

কিন্তু ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র মতে, ১৭৩০ সালে রামজীবন মারা গেলে তার দত্তক পুত্র রামকান্ত রাজা হন। ১৭৫১ সালে রামকান্তের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী ভবানী দেবী রাণী ভবানী নামে উত্তরাধিকারী লাভ করেন। এই জমিদারী পরে নাটোরের রাণী ভবানীর শাসনে আসে ও বহু অঞ্চল নিয়ে বিস্তৃতি লাভ করে। পরে রাণী ভবানীর দেয়া নামই রাজশাহীর নামকরণ করা হয়।

রাণী ভবানী সম্পর্কে মি. গ্রান্ট লিখেছিলেন যে, রাণী ভবানীর জমিদারীকেই রাজশাহী নামে ডাকা হতো। সেখান থেকেই রাজশাহী জেলার নামকরণ।

তবে সাধারণভাবে রাজশাহী শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দুটি ভিন্ন ভাষার একই অর্থবোধক দুটি শব্দের সংযোজন পরিলক্ষিত হয়। সংস্কৃত ‘রাজ’ ও ফারসি ‘শাহী’ শব্দযোগে ‘রাজশাহী’ শব্দের উদ্ভব। দুইটি শব্দের অর্থই রাজা বা রাজকীয় বা বাদশাহ বা বাদশাহী। বাংলা ভাষায় আমরা একই অর্থের অনেক শব্দ দু-বার উচ্চারণ করে থাকি। যেমন- শাক-সবজি, চালাক-চতুর, ধার-দেনা, ঘষা-মাজা, মান-সম্মান, পাহাড়-পর্বত, পাকা-পোক্ত, বিপদ-আপদ ইত্যাদি। ঠিক তেমনি করে এই রাজশাহী শব্দের উদ্ভবও হয়ে থাকতে পারে।

রাজশাহীর ইতিহাস:

রাজশাহী সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য মণ্ডিত একটি শহর। অনেক আগে থেকে এই শহরটি প্রাচীন বাংলায় পরিচিত ছিল। রাজশাহী ছিল প্রাচীন বাংলার পুণ্ড্র সাম্রাজ্যের অংশ। বিখ্যাত সেন বংশের রাজা বিজয় সেনের সময়ের রাজধানী বর্তমান রাজশাহী শহর থেকে মাত্র ৯ কিমি দূরে অবস্থিত ছিল। এ শহরের প্রাচীন নাম ছিল মহাকাল গড়। পরে মধ্যযুগে বর্তমান রাজশাহী পরিচিত ছিল রামপুর বোয়ালিয়া নামে। এর সূত্র ধরে এখনও রাজশাহী শহরের একটি থানার নাম বোয়ালিয়া।

এরপর বাংলার নবাবী আমল ১৭০০ হতে ১৭২৫ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খান সমগ্র বাংলাদেশকে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ১৩ (তের) টি চাকলায় বিভক্ত করেন। যার মধ্যে ‘চারুলা রাজশাহী’ নামে একটি বৃহৎ বিস্তৃতি এলাকা নির্ধারিত হয়। সমগ্র রাজশাহী ও পাবনার অংশ নিয়ে এই চাকলা গঠিত হয়েছিল। পদ্মার উত্তরাঞ্চল বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে পাবনা পেরিয়ে ঢাকা পর্যন্ত এমনকি নদীয়া, যশোর, বর্ধমান, বীরভূম নিয়ে এই এলাকা রাজশাহী চাকলা নামে অভিহিত হয়।

পরে ব্রিটিশ রাজত্বের সময় রাজশাহী বোয়ালিয়া নামে পরিচিত ছিল। তখন এটি ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসাম অঞ্চলের অন্তর্গত রাজশাহী জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র। রাজশাহীকে সে সময়ে রেশম চাষের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল। তখন রাজশাহীতে একটি সরকারী কলেজ ও রেশম শিল্পের জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। সেসময় থেকে দেশবিভাগের পূর্ব পর্যন্ত পদ্মা নদীর উপর দিয়ে প্রতিদিন যাত্রীবাহী স্টিমার চলাচল করত।

১২ জুন ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে রাজশাহী শহরের বেশীরভাগ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে অনেক ভবন আবার নতুন করে স্থাপিত হয়।

রাজশাহী শহরকে কেন্দ্র করে ১৭৭২ সালে জেলা গঠন করা হয়। ১৮৭৬ সালে গঠিত হয় রাজশাহী পৌরসভা। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে রাজশাহী ৯টি উপজেলা নিয়ে গঠিত।

ভৌগোলিক অবস্থান ও আয়তন:

প্রায় ২৪০৭.০১ বর্গ কিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট রাজশাহী জেলার অবস্থান পদ্মার উত্তর তীরে। ২৪ ডিগ্রী ০৭ মিনিট হতে ২৪ ডিগ্রী ৪৩ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮ ডিগ্রী ১৭ মিনিট হতে ৮৮ ডিগ্রী ৫৮ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশে এর অবস্থান। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এই জেলায় ২৩,৭৭,৩১৪ জন মানুষের বসবাস।

হযরত শাহ্ মখদুম রুপোশ (রহ.) এর মাজার শরীফ, রামচন্দ্রপুর দেবীশিংপাড়ায় মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলের স্থাপত্য কীর্তিসহ বহু পুরনো স্থাপনা থেকে ধারণা করা হয় যে শহর হিসাবে রাজশাহীর বয়স প্রায় পৌনে চারশো বছর।

রাজশাহী শহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের অনেকগুলির খ্যাতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। নামকরা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য রাজশাহী শহর শিক্ষানগরী নামেও পরিচিত। রাজশাহী শহরে এবং এর আশেপাশে বেশ কিছু বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক মসজিদ, মন্দির ও উপাসনালয় তথা ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে।

ইচ্ছা করলে প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য আর আম-রেশম বস্ত্রের জন্য বিখ্যাত রাজশাহী থেকে ঘুরে আসতে পারেন।

যাওয়া উপায়:

ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশ পথে রাজশাহী যাওয়া যায়। সড়কপথে ঢাকার গাবতলি ও কল্যাণপুর থেকে বাসে উঠতে হবে। এজন্য গ্রিন লাইন, দেশ ট্রাভেলস, শ্যামলী ও হানিফসহ বেশ কয়েকটি বাস সার্ভিস রয়েছে। শ্রেণিভেদে ভাড়া পড়বে ৪শত থেকে ১ হাজার টাকা।

রেলপথে যাওয়ার জন্য রয়েছে সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ও পদ্মা এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেন। রোববার ব্যতীত প্রতিদিন দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে সিল্কসিটি এক্সপ্রেস এবং মঙ্গলবার ব্যতীত প্রতিদিন রাত ১১টা ১০ মিনিটে কমলাপুর থেকে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া শ্রেণিভেদে ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৮১ টাকা পর্যন্ত।

এছাড়া আকাশ পথে ঢাকার শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ার ও ইউএস-বাংলা এয়ারের বিমানে রাজশাহী যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন:

রাজশাহীতে থাকার জন্য রয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন মোটেল (০৭২১-৭৭৫২৩৭), হোটল হক্স ইন (০৭২১-৮১০৪২০), নাইস ইন্টারন্যাশনাল(০৭২১-৭৭৬১৮৮), মুক্তা ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৭৭১১০০), ডালাস ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৮১১৪৭০)।

 

টাইমস/এএস/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের লক্ষ্য জানালেন সাকিব Apr 25, 2024
img
গাজায় ২০ জনকে জীবন্ত কবর দেয়ার অভিযোগ Apr 25, 2024
img
দীর্ঘ তাপপ্রবাহে রেকর্ড, কতদিন থাকবে জানাল অধিদপ্তর Apr 25, 2024
img
শিক্ষক নিয়োগ: পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে হাতে পৌঁছে যেত উত্তরপত্র Apr 25, 2024
img
বাংলাদেশের উন্নয়নের দিকে তাকালে আমরা লজ্জা পাই: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী Apr 25, 2024
img
রবিবার খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শনিবারও চলবে ক্লাস Apr 25, 2024
img
এক দিনের ব্যবধানে আরও কমলো স্বর্ণের দাম Apr 25, 2024
img
চুয়েট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ Apr 25, 2024
img
যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া বিএনপি: কাদের Apr 25, 2024
img
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত শনিবার: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী Apr 25, 2024