সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় সেই ঘটনার চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। এতে অভিযুক্ত করা হয়েছে কেবল মুসলিম বিক্ষোভকারীদের। সেসময় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে ‘ঘৃণা ছড়ানো ভাষণ’ দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের নাম উল্লেখই করা হয়নি চার্জশিটে। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়- দিল্লি পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্রে ওই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য প্রধানত দায়ী করা হয়েছে সেই সব মুসলিম প্রতিবাদকারীদের, যারা শহরের নানা প্রান্তে তখন দেশের নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। দাঙ্গার ঘটনায় যেসব এফআইআর দায়ের করা হয়েছে বা গ্রেপ্তার হয়েছে; তা থেকে পরিষ্কার, ওই বিক্ষোভে জড়িত মুসলিম নেতা বা ছাত্রছাত্রীদেরই এখন দোষী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে দিল্লির উত্তর-পূর্ব প্রান্তে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় অন্তত ৫৩জন নিহত হয়েছিলেন, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম।
তার ঠিক আগে শহরে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ চলছিল, তখন বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরাও প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে নানা উসকানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিলেন।
দিল্লি বিজেপির বিতর্কিত নেতা কপিল মিশ্রা ২৩ ফেব্রুয়ারি শহরের মৌজপুর চকে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েই হুমকি দিয়েছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতে থাকা অবধি তারা চুপ থাকবেন; কিন্তু তারপর বিক্ষোভকারীরা যদি রাস্তা খালি না করে তাহলে জোর করে তুলে দেবেন, পুলিশের কথাও শুনবেন না।
এর কিছুদিন আগে বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর এই প্রতিবাদকারীদের উদ্দেশ্য করেই জনসভা থেকে স্লোগান দেন “দেশের সঙ্গে যারা বেইমানি করছে তাদের গুলি করে মারা হবে।”
কিন্তু দিল্লি পুলিশের চার্জশিটে দাঙ্গা কীভাবে হল, তা নিয়ে যে দীর্ঘ ঘটনাপরম্পরা বর্ণনা করা হয়েছে তাতে এসব বক্তৃতার কোনো উল্লেখই নেই।
তদন্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে
দিল্লির দাঙ্গাপীড়িতদের হয়ে অনেকগুলো মামলা লড়ছেন মানবাধিকার আইনজীবী কলিন গঞ্জালভেস। তিনি বলছিলেন, “দাঙ্গার সময় পুলিশের বিরুদ্ধেই মারধর, অগ্নিসংযোগ বা ভয় দেখানোর অন্তত আশি-নব্বইটা অভিযোগ এসেছে, কিন্তু পুলিশ একটারও এফআইআর নিতে রাজি হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “ভিকটিমদের বয়ানের ভিত্তিতে নয়, পুলিশ তদন্তটা সাজিয়েছে তাদের বানানো গল্প আর সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে। অথচ আমরা সবাই জানি দাঙ্গার মূলে ছিল বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের ঘৃণা ছড়ানো ভাষণ!।”
সাংবাদিক-অ্যাক্টিভিস্ট সারা নাকভিও বিবিসিকে বলছিলেন, “বেশির ভাগ টিভি চ্যানেলের ন্যারেটিভে যেভাবে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের দেশদ্রোহী সাজানো হয়েছে; দিল্লি পুলিশও ঠিক সেই লাইনেই তদন্ত করেছে। মনে রাখতে হবে ওই প্রতিবাদ ছিল নাগরিকদের সমানাধিকারের দাবিতে একটা সিভিল রাইটস মুভমেন্ট। আর দিল্লি পুলিশের চার্জশিট পড়লে মনে হচ্ছে মুসলিমরা এতই চালাক আর ক্ষমতাশালী যে তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর দাঙ্গা চালিয়েছে।'
দিল্লিতে শাহীনবাগ, জামিয়া মিলিয়া বা জাফরাবাদের মতো যারা নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, দিল্লি পুলিশ দাঙ্গায় তাদের ভূমিকা বিশদে বর্ণনা করেছে এবং এরা প্রায় সবাই মুসলিম। এর আগে দাঙ্গার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে আম আদমি পার্টির বহিষ্কৃত কাউন্সিলর তাহির হোসেনকেও তারা শনাক্ত করেছে।
কেন চার্জশিটে বিজেপি নেতাদের নাম নেই?
চার্জশিটের কোথাও বিজেপি নেতাদের নাম ঘুণাক্ষরেও আসেনি। দিল্লি পুলিশের সাবেক একজন কমিশনার, নীরজ কুমার অবশ্য মনে করেন, “কপিল মিশ্রার বিরুদ্ধে যেহেতু সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাটের করা মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন, তাই চার্জশিটে তার বক্তৃতার কাঁটাছেড়া করা সম্ভব হয়নি।”
তিনি আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “দিল্লি পুলিশ কখনওই বলেনি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে না - দাঙ্গায় সবগুলো মামলার সঙ্গে তার বক্তৃতার সম্পর্কও ছিল না।”
চূড়ান্ত চার্জশিট জমা দেয়ার জন্য দিল্লি পুলিশ যে ৯০ দিনের সময় পেয়েছে তার অবশ্য এখনো কিছুটা বাকি আছে। কিন্তু এ পর্যন্ত যে ৭০টি চার্জশিট পেশ করা হয়েছে তা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে, বিজেপি নেতারা দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগ থেকে শেষ পর্যন্ত রেহাই পেয়েই যাবেন।
টাইমস/জিএস