এশিয়াজুড়ে সমালোচক সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ

দুর্যোগকালীন সময়ে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা না গেলে গুজব ছড়ায়। করোনা মহামারির এই সময়েও তাই হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এশিয়াসহ সারা বিশ্বেই বিভিন্ন অপপ্রচার, ফেক নিউজ ও গুজব প্রচার ছড়াচ্ছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার সমালোচক সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করছে বলে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিপাইনে একটি টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার এক মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। ৫ মে সন্ধ্যা সাতটা ৫২ মিনিটে দেশটির সবচেয়ে বড় সম্প্রচার-মাধ্যম এবিএস-সিবিএন-এর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। প্রত্যক্ষভাবে প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুয়ার্তের সঙ্গে কয়েক বছরের বিরোধের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। পরোক্ষভাবে কোম্পানিটির লাইসেন্সের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দুয়ার্তের প্রশাসন। এতে করে সাংবাদিক ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের কাছে পরিষ্কারভাবে এই বার্তা পৌঁছে গেছে যে, সরকারের কঠোর সমালোচনার পরিণাম কী হতে পারে।

ফিলিপাইনের এই ঘটনা এশিয়ার সাংবাদিক ও মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকেই বিস্মিত করবে না। পুরো মহাদেশেই সরকারি বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার, ওয়ারেন্ট ছাড়াই ট্যাক্স তদন্ত, ভুয়া অপরাধের অভিযোগ, ফেক নিউজ প্রচারণা, অনলাইন ট্রলসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের চাপ রয়েছে।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের মতে, ২০১৮ সাল থেকে এশিয়ার ১২টিরও বেশি দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইন। সংস্থাটি ১৮০টি দেশে সাংবাদিকদের স্বাধীনতার যে সূচক প্রকাশ করে তার মধ্যে সবচেয়ে নিপীড়ক দেশগুলোর এক তৃতীয়াংশ এশিয়ার। তালিকার তলানিতে উত্তর কোরিয়া, তুর্কমেনিস্তান (১৭৯তম), চীন (১৭৭তম) ও ভিয়েতনাম (১৭৫তম)।

যেসব দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে, সেসব দেশে কখনোই এর খুব বেশি ঐতিহ্য ছিল না। কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হান সেন প্রায় ৪০ বছর আগে গণহত্যাকারী খেমার রুজ শাসনের পতন পর থেকেই ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তৎপরতা তিনি ধারাবাহিকভাবে ঠেকিয়ে গেছেন। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে বেশ কয়েকটি স্বাধীন রেডিও চ্যানেল এবং একটি সমালোচনামূলক পত্রিকা কম্বোডিয়া ডেইলি বন্ধ করে দেয়া ছিল কেবল একটি বৃহত্তর তৎপরতার অংশ।

একইভাবে মিয়ানমারে গত চার বছরে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী তাদের সমালোচকদের বিরুদ্ধে ৫২টি মামলা করেছে। এর অর্ধেকের বেশি হয়েছে কেবল গত এক বছরেই। সেনাবাহিনীর হাতে বেসামরিক নাগরিক হত্যার তথ্য উন্মোচন করে এক বছরের বেশি কারাদণ্ড ভোগ করেছেন ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের দুই সাংবাদিক।

পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সমালোচকরা ঘরে-বাইরে ভীতি ও হামলার শিকার হচ্ছেন। দেশটির জনপ্রিয় চ্যানেল জিও টিভির সম্প্রচার ২০১৮ সালে বেশ কয়েক মাস বন্ধ থাকে। দেশটিতে সাংবাদিকদের সুরক্ষায় সরকারের ভূমিকা খুবই সামান্য। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পাকিস্তানে ৩৩ জন সাংবাদিক খুন হলেও কোনো হত্যাকাণ্ডের জন্য কারো শাস্তি হয়নি।

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাতেও তদন্তে অবহেলার কারণে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।

আশঙ্কার বিষয় হলো- সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাস থাকা দেশগুলো এখন সাংবাদিকদের অগ্রাহ্য করা শুরু করেছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারতের ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেই চান না। তিনি কেবল দূরেই থাকেন না, তার আচরণগুলোও বিরোধপূর্ণ। ফলে সরকারের সমালোচনার কারণে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকেরাও মামলা দায়ের অতি সাধারণ ঘটনা হয়ে পড়েছে।

যেমন, ৮ জুন এডিটর্স গিল্ড অব ইন্ডিয়ার এক বিবৃতিতে দিল্লি পুলিশের এক তদন্তের নিন্দা জানানো হয়। এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মোদির দলের মুখপাত্রের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে ওই তদন্ত শুরু হয়। মোদির ট্রল আর্মি সমালোচক রিপোর্টারদের অনলাইনে আক্রমণ চালিয়ে থাকে। প্রায়ই এসব সাংবাদিকদের ঠিকানা কিংবা অন্য ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে দেয়া হয়।

এছাড়ও বাণিজ্যিক চাপ আছে। বন্ধু নয়, এমন সংবাদপত্রগুলো সরকারি বিজ্ঞাপন পায় না। আর সে কারণে বেশিরভাগ টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রের মালিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে নিতে চাপ দেয়ার সুযোগ পায়।

কোভিড-১৯ মহামারি এশিয়ার সরকারগুলোকে সাংবাদিকদের ওপর চাপ প্রয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে। রোগটি নিয়ে মিথ্যা ছড়ানোর অভিযোগ এনে ৫১ জনকে গ্রেফতার করেছে ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়াতেও মহামারি নিয়ে ফেক নিউজ ছড়ানোর অভিযোগ এনে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে ২৯ ব্যক্তিকে। রোগ নিয়ন্ত্রণে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াতে জারি করা জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করে সরকার সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন মিলে বাখেলেট বলেছিলেন, বেশ কয়েকটি দেশ করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে ‘ভিন্নমত বা অবাধ তথ্য প্রবাহ ও বিতর্ক’ স্তব্ধ করছে। অনেক দেশই তার সমালোচনা উড়িয়ে দিয়েছে।

 

টাইমস/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সারাদেশে ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট জারি Apr 19, 2024
img
বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীদের তালিকায় আলিয়া Apr 19, 2024
img
পালিয়ে আসা ২৮৫ জনকে ফেরত নিচ্ছে মিয়ানমার: পররাষ্ট্রমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
গ্রেপ্তারি পরোয়ানার শঙ্কায় নেতানিয়াহু, ইসরায়েলে জরুরি বৈঠক Apr 19, 2024
img
পালিয়ে বাংলাদেশে এলেন আরও ১১ বিজিপি সদস্য Apr 19, 2024
img
কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন শেখ হাসিনা Apr 19, 2024
img
প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন : অর্থমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে গেল বাস, প্রাণ গেল প্রকৌশলীর Apr 19, 2024
img
চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি Apr 19, 2024
img
৩টি ড্রোন ধ্বংস করল ইরান, ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনা নিরাপদ Apr 19, 2024