উত্তর কোরিয়ার ‍‘হাস্যকর’ নির্বাচন !

ভোট মানুষের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। আর এই ভোট শব্দটা শোনা মাত্রই আমরা বুঝতে পারি যে, এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে অনেক প্রার্থী থাকবেন এবং ভোটাররা ভোট প্রয়োগ করার মাধ্যমে তাদের পছন্দের প্রার্থী বা দলকে নির্বাচিত করবেন। কিন্তু এই ভোট যদি হয় এমন যে, এখানে একটিই দল, প্রার্থীও একজন, তাকেই ভোট দিতে হবে, ভোট না দিলেও শাস্তি । এছাড়া ‘না ভোট’ দেয়ার সুযোগ আছে তবে সেটা করলেও শাস্তি। এমন ক্ষেত্রে আমরা এটাকে কী ভোট বলতে পারি?

আমরা এটাকে ভোট বলে মেনে নিতে পারি আর নাই পারি, উত্তর কোরিয়ার জনগণকে কিন্তু এমনটাই মেনে নিতে হয়। নির্বাচন আসলে এমনই এক হাস্যকর ভোটে অংশ নিতে বাধ্য হতে হয় জনগণকে।

উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ আইন পরিষদকে বলা হয় ‘সুপ্রিম পিপল’স অ্যাসেম্বলি’ (এসপিএ)। এর সদস্য সংখ্যা ৬৮৭ জন। প্রতি পাঁচ বছর পর পর এই পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হন।

এসপিএ সদস্যদের নির্বাচিত করতে উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনে প্রধানত একটি রাজনৈতিক জোট অংশগ্রহণ করে। এর নাম হল- ‘ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ফর দ্য রি-ইউনিফিকেশন অব দ্য ফাদারল্যান্ড’। এই জোটের অধীনে ওয়ার্কার্স পার্টি অব কোরিয়া, কোরিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, চনডুয়িস্ট চঙ্গু পার্টি ও স্বতন্ত্র সদস্যরা নির্বাচনে অংশ নেয়।

তবে মজার বিষয় হল- এখানে প্রত্যেক দল কতটি আসনে লড়বে তা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। অর্থাৎ দলগুলো ইচ্ছামতো যেকোনো সংখ্যক আসনে প্রার্থী দিতে পারে না। সেখানে ওয়ার্কার্স পার্টি অব কোরিয়া ৮৭.৫ শতাংশ, কোরিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ৭.৪ শতাংশ, চনডুয়িস্ট চঙ্গু পার্টি ৩.২ শতাংশ এবং স্বতন্ত্র সদস্যরা ১.৯ শতাংশ আসনে নির্বাচন করে। আর কে কোন আসনে নির্বাচন করবে তাও নির্ধারিত থাকে।

আরও মজার ব্যাপার হল এখানে ভোটের সময় গোপনীয় ব্যালট পেপার থাকলেও ভোটারের তথ্যের কোনো গোপনীয়তা থাকে না। আর ব্যালট পেপারে প্রার্থী থাকেন মাত্র একজন। ভোটারকে ওই একজন প্রার্থীকেই ভোট দিতে হবে। তবে চাইলে তিনি না ভোট দিতে পারবেন। এক্ষেত্রে তিনি লাল কালি দিয়ে প্রার্থীর ছবির উপর ক্রস চিহ্ন দিবেন।

বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, না ভোটের সুযোগ থাকলেও এজন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। অর্থাৎ না ভোট দিলে ভোটারকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। আবার ভোটে না আসলেও শাস্তি আছে। যারা ভোটে অনুপস্থিত থাকবে বা ভোটদান থেকে বিরত থাকবে তাদের তালিকা করা হবে এবং শাস্তি হবে। তাই ভোটাররা বাধ্য হয়েই নির্বাচনে অংশ নেয় এবং নির্বাচনে অংশ নেয়া দলটি ১০০ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতা ভোগ করে।

এই কারণেই নির্দিষ্ট সময়ে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার জনগণকে বাধ্য হয়েই ভোটে যেতে হয়। যাকে প্রকৃতপক্ষে ভোট বলা যায় না। কিন্তু কেন? যেহেতু ভোটের প্রার্থী এবং ফলাফল সবই আগে থেকেই নির্ধারিত, তবে কেন এই হাস্যকর ও নামে মাত্র ভোটের আয়োজন করা হয়?

বিশ্লেষকদের মতে, এই নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার শাসকগোষ্ঠীর প্রতি জনগণের আনুগত্য নিশ্চিত করা। অর্থাৎ এর মাধ্যমে প্রতি পাঁচ বছর পর পর সুপ্রিম পিপল’স অ্যাসেম্বলির নতুন সদস্যদের নির্বাচিত করা হয়, যারা কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে।

বিশ্লেষকরা উত্তর কোরিয়ার এই হাস্যকর নির্বাচনের কঠোর সমালোচনা করেন। কারণ এটা আদৌ কোনো নির্বাচন নয়। এটা কেবল একটা লোক দেখানো একটি নির্বাচন। কারণ এখানে সব প্রার্থীই মাত্র একটি রাজনৈতিক জোট কর্তৃক নির্ধারিত হয়। ভোটারদের কোনো গোপনীয়তা নেই। না ভোট দেয়ার সুযোগ থাকলেও এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ নির্ধারিত প্রার্থীর বিপক্ষে ভোট দিলে এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা ও রাজদ্রোহ অপরাধ বলে মনে করা হয়। তাই যারা এটা করে, অতিরিক্ত নজরদারির পাশাপাশি তাদেরকে ঘর-বাড়ি ও চাকরি হারাতে হয়।

মূলত এই হাস্যকর, নির্লজ্জ ও পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া তার স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে জোরপূর্বক বৈধ করে নেয়।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ইরানে ইসরায়েলি হামলা, লাফিয়ে বাড়ল তেল ও স্বর্ণের দাম Apr 19, 2024
img
ঢাকাসহ ৬ বিভাগে ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস Apr 19, 2024
img
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এলেন আরও ১৩ বিজিপি সদস্য Apr 19, 2024
img
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ আটকে দিল যুক্তরাষ্ট্র Apr 19, 2024
img
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভোট শুরু Apr 19, 2024
img
ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল Apr 19, 2024
img
রেমিট্যান্স উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি : সমাজকল্যাণমন্ত্রী Apr 18, 2024
img
ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, ভ‌রি‌ ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৩৮ টাকা Apr 18, 2024
img
গবেষণায় বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া শিশুখাদ্য সেরেলাক নিয়ে উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য Apr 18, 2024
img
আ.লীগের এমপি-মন্ত্রীর সন্তান-স্বজনদের উপজেলা নির্বাচন করতে মানা Apr 18, 2024