নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে ভয়াবহ হামলার কয়েক মিনিট আগে হামলাকারীর মেনিফেস্টোসহ একটি মেইল পায় দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দফতর। সে মেইল অন্য কেউ নয় স্বয়ং করেছিলেন হামলাকারী ব্রেন্টন ট্যারান্ট। প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন এবং অন্য রাজনীতিকদেরকে ইমেইলটি পাঠান তিনি।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর প্রধান প্রেস সচিব অ্যান্ড্রো ক্যাম্পবেলের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এমন তথ্য জানিয়েছে। খবর দ্য গার্ডিয়ানের।
এ হামলার ৮৭ পৃষ্ঠার মেনিফেস্টো প্রায় একই সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পোস্ট করা হয়েছিল। যেখানে অভিবাসী এবং মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য রয়েছে।
অ্যান্ড্রো ক্যাম্পবেল বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, হামলার কয়েক মিনিট আগে ওই মেনিফেস্টোসহ একটি মেইল পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
তিনি জানান, একজন কর্মকর্তার অ্যাড্রেসে ইমেইলটি পাঠানো হয়েছিল। তবে তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয়নি।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও দেশটির স্পিকার এবং অন্যান্য রাজনীতিকদের কাছেও ওই মুসলিমবিদ্বেষী ইশতেহারটি ইমেইল করেছিল খুনি অস্ট্রেলীয় নাগরিক ব্রেন্টন ট্যারান্ট। ১৬ হাজার ৫০০ শব্দের ওই ইশতেহারে নৃশংস এ হামলার পেছনে নিজের বক্তব্য তুলে ধরে এই অস্ট্রেলীয় নাগরিক। সেখানে মোটা দাগে উঠে আসে মুসলিমবিদ্বেষ, অভিবাসী বিদ্বেষ ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের মতো বিষয়গুলো। মুসলমানদের উসমানীয় খিলাফতের (বর্তমান তুরস্ক) বিরুদ্ধে তৎকালীন ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের বিজয়ের কথাও উল্লেখ করেছে সে।
কথিত ইশতেহারে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের এই নৃশংস খুনি দাবি করেছে, শ্বেতাঙ্গরা গণহত্যার শিকার এবং সে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে দিতে চায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘শ্বেতাঙ্গ পরিচয়ের নতুন প্রতীক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে মুসলমানদের জন্য একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরিরও আহ্বান জানিয়েছে সে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়ে ট্যারান্টের এক ধরনের আসক্তি রয়েছে। নরওয়ের আরেক বন্দুকধারী খুনি আন্ড্রেস ব্রেইভিকের সঙ্গে তার ‘গভীর যোগাযোগ’ ছিল। সে এ হামলা চালানোর জন্য তাকে উসকানি দিয়েছে। ব্রেইভিক ২০১১ সালে নরওয়েতে হামলা চালিয়ে ৭৭ জনকে হত্যা করেছিল।
কথিত ইশতেহারে হামলাকারী নিজের সম্পর্কে বলেছে, ‘আমার ভাষার উৎস ইউরোপীয়। আমার রাজনৈতিক আদর্শ ইউরোপীয়। আমার দার্শনিক অবস্থান ইউরোপীয়। আমার পরিচয়, আমি ইউরোপীয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমার রক্ত ইউরোপীয়।’ লেখক তার পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছে, সে একটি শ্রমজীবী শ্রেণির নিম্ন আয়ের পরিবারে বেড়ে উঠেছে। তার ভাষ্য, ‘আমি একটা সাধারণ পরিবার থেকে আসা সাধারণ এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, যে তার নিজ গোষ্ঠীর মানুষের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার বাবা-মা স্কটিশ-আইরিশ-ইংলিশ বংশোদ্ভূত। আমার একটা সাধারণ শৈশব কেটেছে, যেখানে বলার মতো কোনও ঘটনা নেই।’ তার দাবি, সে একজন ‘অন্তর্মুখী’ মানুষ, একজন ‘নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদী’ এবং ‘ফ্যাসিস্ট।’
ট্যারান্ট লিখেছে, এই হামলার পরিকল্পনা দুই বছর আগের। নিউ জিল্যান্ড হামলার স্থান হিসেবে প্রথম পছন্দ ছিল না। তিন মাস আগে হামলার জন্য নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চকে বেছে নেওয়া হয়। ‘আমি নিউ জিল্যান্ডে এসেছিলাম সাময়িক সময়ের জন্য, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রশিক্ষণ নিতে। কিন্তু এখানে এসে আমি আবিষ্কার করি, বিশ্বের অন্য যে কোনও ভালো টার্গেটের চেয়ে এটি কোনও অংশে কম নয়।’
এই অস্ট্রেলীয় খুনির ভাষায়, ‘আমি বার্তা দিতে চেয়েছিলাম যে দুনিয়ার কোনও স্থানই নিরাপদ নয়। আমি সংশ্লিষ্ট অস্ত্রটি এই কারণেই বেছে নিয়েছিলাম যেন ঘটনাটি ব্যাপক প্রচার পায়, মানুষের আলোচনায় ও সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পায়।’ ট্যারান্টের ব্যবহৃত অস্ত্রটি ছিল একটি আধা-স্বয়ংক্রিয় রাইফেল।
শনিবার সকালে হামলার সন্দেহভাজন মূলহোতা অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত ব্রেন্টন ট্যারেন্টের (২৮) বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইন লঙ্ঘনসহ আরও বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনা হবে বলে ধারণা করছেন আইন প্রণেতারা।
আদালতে হাজির করা হলে আসামির পক্ষ থেকে কোনো জামিনের আবেদন পড়েনি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর মামলার শুনানির জন্য আগামী ০৫ এপ্রিল তাকে আবারও হাজির করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
টাইমস/এইচইউ