ফেসবুক বন্ধুর ভয়াবহ প্রতারণার কাহিনি

এই প্রতিবেদনটি ৫১ বছর বয়সী এক বিধবা নারীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ প্রতারণার কাহিনি। স্বামী মারা যাওয়ার পর একাকীত্ব কাটাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের। পরিচয় হয় অনেক অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে। তারমধ্যে ছিল মনীশ কুমার নামে এক ব্যক্তি। যিনি নিজেকে ব্রিটেনের বাসিন্দা বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই নারী ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারেননি এই লোকের কারণে খোয়া যাবে তার প্রায় ৯০ লাখ রুপি।

ওই নারীর ছেলে থাকেন ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের পুনাতে। মেয়েও কর্মসূত্রে গুরুগ্রামে। স্বামী ছিলেন দেশের একটি প্রথম সারির বেসরকারি সংস্থার শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তা। কিন্তু বছর দুয়েক আগে অবসরের কয়েক মাস পরেই তিনি মারা যান। তারপর থেকে গড়িয়াহাটে একটি অভিজাত আবাসনের ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন ৫১ বছর বয়সী বিশাখা চট্টোপাধ্যায় (নাম পরিবর্তিত)।

২০১৭-র এপ্রিলে ফেসবুকে নিজের নামে একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন বিশাখা। পরে সেখানেই এক ব্যক্তির সঙ্গে তার আলাপ হয়। কিন্তু সেই আলাপেই যে তার ৯০ লাখ টাকা খোয়া যাবে, তা ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তিনি। গত ২৩ মার্চ কলকাতা পুলিশের সাইবার অপরাধ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন ওই নারী।

বিশাখা অভিযোগে বলেছেন, চলতি বছরের গোড়ার দিকে ফেসবুকে মনীশ কুমার নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার আলাপ হয়। মনীশ কুমার নিজেকে ব্রিটেনের বাসিন্দা বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তিনি একজন পাইলট। ফেসবুক ছেড়ে আলাপচারিতা গড়ায় হোয়াটসঅ্যাপেও।

অভিযোগ, সেই বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই মনীশ কুমার এক দিন বিশাখাকে জানান, তিনি কিছু প্রসাধন সামগ্রী পার্সেল করে পাঠিয়েছেন উপহার হিসেবে।

মনীশ ওই নারীকে একটি বেসরকারি ভারতীয় ব্যাংকের জয়পুর শাখায় জনৈক সেলিম খানের অ্যাকাউন্টে ৪৫ হাজার রুপি জমা করতে বলেন। ওই পার্সেল ছাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় শুল্ক হিসাবেই ওই টাকা জমা করতে বলা হয়।

পুলিশের কাছে বিশাখা দাবি করেন, গত ৮ মার্চ সেই টাকা জমা করে দেন তিনি। অভিযোগ, এর পরে মনীশ আবার তাকে জানান আসলে ওই পার্সেলে প্রসাধন সামগ্রী নয়, আছে প্রায় ৭০ হাজার ডলার মূল্যের গয়না। ভারতীয় মুদ্রায় যা ৪৮ লাখেরও বেশি। মনীশ ওই নারীকে জানান, পার্সেলে থাকা গয়নার হদিস পেয়ে গিয়েছেন শুল্ক দপ্তরের কর্মকর্তারা। তাই স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে টাকা দিতে হবে ওই পার্সেল ছাড়াতে।

কলকাতা পুলিশের সাইবার ক্রাইম থানার তদন্ত কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, মণীশের কথা বিশ্বাস করে পরবর্তী দু’সপ্তাহে দফায় দফায় সাড়ে ৮৯ লাখ টাকা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ১১টি আলাদা আলাদা ব্যাংকে জমা করেন ওই নারী। তারপরেও পার্সেল না আসায় তিনি বুঝতে পারেন যে, প্রতারিত হয়েছেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রতারকরা গোটা বিষয়টি আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে ব্যাংক অব আমেরিকার প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে ফোন এবং ই-মেইল করে।

তদন্তে নেমে পুলিশ এখন পর্যন্ত ১১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের হদিস পেয়েছেন যেখানে ওই টাকা পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি মিলেছে দু’টি ফোন নম্বর, যে নম্বর থেকে ব্যাংক অব আমেরিকার প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে ফোন করা হয়।

এর আগে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা এক যুবকও ঠিক একইভাবে ফেসবুকে পরিচয় হওয়া ‘ব্রিটিশ বান্ধবীর’ ফাঁদে পা দিয়ে ২০ লাখ টাকা খুইয়েছিলেন। সেই মামলার তদন্ত করে কলকাতা পুলিশের ব্যাংক জালিয়াতি দমন শাখা।

তারা দিল্লি থেকে নাইজেরীয় জালিয়াতদের একটি দলকে পাকড়াও করেছিল। কিন্তু প্রতারণার টাকা উদ্ধার করতে পারেনি।

তদন্তকারীদের অভিজ্ঞতা, এ ধরনের প্রতারণার পিছনে থাকে নাইজেরীয় জালিয়াতরা। অ্যাকাউন্টগুলো ভাড়া নেওয়া হয়। টাকা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট অংকে ওই টাকা আবার চলে যায় অন্য অ্যাকাউন্টে। তাই ওই অ্যাকাউন্টের মালিকদের হদিস পেয়েও খুব একটা লাভ হয় না।

তদন্তকারীদের দাবি, প্রতারণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই জালিয়াতরা টাকা নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দেয়। তাই টাকা উদ্ধারের সম্ভাবনা কমে যায়।

আনন্দবাজার জানায়, একই ধরনের পর পর ঘটে যাওয়া কয়েকটি অপরাধের ঘটনা থেকে তদন্তকারীদের একাংশ মনে করছেন, জালিয়াতরা সোশ্যাল সাইটে ওই নারীর মতো ‘একাকী’ মানুষদেরই বন্ধুত্বের টোপ দেয়। কারণ দক্ষিণ কলকাতার যে যুবক একই ভাবে প্রতারিত হয়েছিলেন তিনিও বিবাহ বিচ্ছিন্ন ছিলেন। তাই সাইবার বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল সাইটে নিজের সম্পর্কে বেশি তথ্য না দেওয়াই ভালো এবং মনে রাখা উচিৎ ভার্চুয়াল জগতে ভুয়ো পরিচয়ে প্রোফাইল তৈরি করা কোনো কঠিন বিষয় নয়।

 

 

টাইমস/এসআই

 

 

 

Share this news on: