রান্নার কৌশল ও খরচ ব্যবস্থাপনা

আমরা প্রায় সবাই রেস্তোরাঁর খাবারের প্রতি আকৃষ্ট। তার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো খাবারের মুখরোচক স্বাদ ও গন্ধ। আরেকটি কারণ হলো, ওইসব বাহারি খাবার তৈরিতে আমাদের অপারগতা। আমরা অনেকেই জানি না যে সহজপ্রাপ্য সচরাচর উপায় উপকরণ দিয়েই রেস্টুরেন্টের চেয়েও মজাদার স্বাস্থ্যকর খাবার ঘরেই বানানো যায়।

রান্নার স্বাদের বৈচিত্র‍ লক্ষ করলে দেখা যায়, খাবারের মৌলিক স্বাদ মূলত মিষ্টি, ঝাল, টক ও মিশ্র।

মজাদার রান্নার খুবই কার্যকরী কৌশল হলো, আপনি যে স্বাদের রান্না করতে চান সেই স্বাদটা নিয়ন্ত্রণ করা। যেমন, আপনি টক আচার বানাতে চাইলেও সেখানে চিনি বা গুড় ব্যবহার করতে হবে। তবে পরিমাণটা এমন হতে পারবে না যে, আচার মিষ্টি হয়ে যায়। আবার টক স্বাদের চাটনি জাতীয় কিছু রান্না, যেমন বেগুনের দোলমা, পেপের টক বা টকি সালাদ বানাতে নিয়ন্ত্রিত তেঁতুল ব্যবহার আপনার রান্নার মান তরতর করে উপরে নিয়ে যাবে। রান্নায় লবণ, তেল ও মসলার পরিমাণ কন্ট্রোল করতে পারলে খাবারের স্বাদ ও কালার অনেক গ্রেভি হয় যা রাঁধুনী হিসাবে আপনার গ্রেডিং বাড়াবে খাবার চেখে দেখার আগেই!

অনেকেই তেল ও মরিচের গুড়াকে ভালো রান্নার হাতিয়ার হিসাবে প্রয়োগ করে থাকে যা আদতে নিজের ও পরিবারের ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। লবণ দেয়ার মাপ যারা ঠিক রাখতে পারে না, তারা শুরুতে অল্প লবণ দিয়ে শেষের দিকে লবণ চেখে সমন্বয় করে রান্না শেষ করলে লবণের পরিমাণ এতটাই পারফেক্ট হয় যে সবাই অবাক না হয়ে পারে না!

তরকারিতে ভুলে মসলা বা লবণ বেশি হয়ে গেলে কিছু কাঁচাপেঁপে বা আলু ছেড়ে দিন, মসলা এডজাস্ট হয়ে যাবে। অতিরিক্ত তেল পরে গেলে চামচ দিয়ে উঠিয়ে রাখুন পরে অন্য রান্নায় ব্যবহার করে নেবেন। জিরা ভেজে গুরো করে ব্যবহার করলে সুঘ্রান ছড়াবে এবং ঝোল গাঢ় হবে। কাঁচা মরিচ রান্নার শেষের দিকে দিয়ে ঢেকে দিলে বাড়তি স্বাদ ও সুগন্ধ পাবেন।

নুডুলস, চিকেন ফ্রাই, মাশরুম, চপজাতীয় খাবারে সাদা গোলমরিচের গুড়া ছিটিয়ে দিলে মুখে পানজেন্ট স্বাদ আসবে আবার পুষ্টিও পাওয়া যাবে। রেস্টুরেন্টের বেশিরভাগ খাবারে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট, অস্বাস্থ্যকর সস ব্যবহার করে স্বাদ বাড়ানো হয়। লক্ষ করলে দেখবেন খাওয়ার সময় মজা লাগলেও পরে মুখে কেমন তেতো স্বাদ আর ভমিটিং টেনডেন্সি দেখা দেয়। এবং শরীরে অস্বস্তিবোধ তৈরি করে।

রান্নার খরচাপাতি:

মজার আর আকর্ষণীয় রান্না মানেই যে খরচের বাহার, তা কিন্তু মোটেই সত্য নয়। বরং রেস্টুরেন্টের যে খাবার ৫০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয় তা ঘরে ৬০-৭০ টাকায় রান্না সম্ভব! হ্যাঁ, আসলেই সম্ভব। আমি তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করে দিচ্ছি।

নুডুলস:

ডুডুলস নুডুলস এর ৩৮ টাকার এক প্যাকেটের অর্ধেকটা রান্না করলে পাঁচজন পেট পুরে খেতে পারে। রেস্টুরেন্টে নুডুলস এর সাথে মাংস, চিংড়ি, সবজি ইত্যাদি মিশিয়ে স্বাদ বাড়ানো হয়। ঘরেও সহজে এটা করা যায়। এতে বড়জোর ২ পিস মাংসের টুকরো, ২ পিস মাঝারি সাইজ চিংড়ি, একটা গাজরের তিন ভাগের একভাগ, একটা পাতাকপির ত্রিশ ভাগের একভাগ কুচিকুচি করে ভেজে দিলে আর একটা ডিম দিলে রেস্টুরেন্ট চ্যালেঞ্জ এক বোল নুডুলস হবে। টমেটো অর্ধেকটা দিতে পারলে তো কথাই নাই। মিক্সারটা যে পরিমাণ হবে তা যেকোনো সস্তামানের রেস্তোরাঁতেও কমবেশি ৩০০ টাকা দাম হবে। আপনি কত খরচ করলেন ভেবে দেখুন।

চিকেন ফ্রাই:

দেড় কেজি ওজনের একটা ব্র‍য়লার মুরগীর দাম হাইয়েস্ট ১৮০-২০০ টাকা। এতে ৫০ টাকা দামের রেস্টুরেন্ট সাইজ চিকেন ফ্রাই হবে মিনিমাম ১৬ পিচ। মানে ৮০০ টাকার চিকেন ফ্রাই পাবেন ২০০ টাকায়। গিলা, কলিজা, পা, গলা ইত্যাদি ২/৩টা আলু দিয়ে ভুনা করলে একদিনের তরকারি হয়ে যাবে। তেল, মসলা, কর্ন ফ্লাওয়ার, বেসন ইত্যাদি খুব সামান্য পরিমাণ লাগে। কাজেই খরচ অনেক বেশি হয় না।

ব্রেইন মাসালা:

একটি গরুর মগজ ১২০-১৫০ টাকায় পাওয়া যায়। খাসির মাথা ২০০ টাকা। খাসির মাথায় হাফ কেজির বেশি মাংস হয়। নরম হাড্ডিসহ মাংস বিশেষ সুস্বাদু। মাথার মগজের সাথে পেয়াজকুচি মিলিয়ে নামজাদা কাবাবের দোকানের চেয়েও মজাদার ব্রেইন মাসালা রান্না করা যায়। গরুর মগজে যে পরিমাণ হবে তা রেগুলার কাবাবের প্রাইস অনুযায়ী ৭০০-৮০০ টাকার হবে।

ফিস ফিংগার:

আপনি বাহিরে যে ফিস আইটেম যেমন ফিস ফিংগার, ফিস বার্গার ইত্যাদি খান তা আসলে পাংগাস মাছ থেকে তৈরি! ১৫০ টাকার পাংগাস কিনলে একদিন রান্না, প্রতিবেশীকে তরকারি দেয়া, বাসার ডোমেস্টিক হেল্প আন্টিকে এক পোটলা মাছ দিয়েও যে পরিমাণ ফিস আইটেম ফাস্ট ফুড বানাতে পারবেন তা দিয়ে ৩-৪ দিন নাস্তা করতে পারবেন। বুটের ডাল সেদ্ধ আর মাছ মিশিয়ে কী জিনিস প্রস্তুত হয় একবার টেস্ট করেই দেখুন। এভাবে প্রতিটা খাবারের বর্ণনা দেয়া সম্ভব।

বাসায় রান্না কেন করবেন?

ব্যস্ত নাগরিক জীবনে পারিবারিক জীবন ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা পার করছে। সম্পদ দিয়ে ভালবাসা মাপা হচ্ছে। পয়সা দিয়ে সময় কেনা হচ্ছে। এমন দিনে পরিবারের সবার সাথে ফলপ্রসূ সময় দেয়া হচ্ছে না। তাই রান্নাটা ঐতিহ্য ফিরানোর একটা উপলক্ষ হতে পারে। সবার অংশগ্রহণে রান্না একটা পারিবারিক আনন্দের আবহ সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া শুধু বেশি খরচের ভয়ে খাদ্যবিনোদন থেকে দূরে থাকার মানেই হয় না। তাই রান্না করুন,পয়সা বাঁচান,প্রিয়জনের সাথে সময় কাটান। সুখী হোক সবার জীবন।

 

লেখক: বেল্লাল হোসাইন, শিক্ষানবিস আইনজীবী ও সমাজকর্মী

           নাজমিন আক্তার, সহকারী জজ, চুয়াডাঙ্গা। (লেখকদ্বয় দম্পতি)

 

টাইমস/এইচইউ

Share this news on: