একজন সৎ প্রকৌশলীর কিলিং মিশনে খরচ ১৫ হাজার টাকা!

দেলোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ’৮৬ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সততার সঙ্গে। এটাই তার জীবনের জন্য কাল হল। অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজসে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আর ওই কিলিং মিশনে খরচ হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার টাকা। খুনের দায়ে অভিযুক্ত আনিছুর রহমান ওরফে সেলিমও একজন সহকারী প্রকৌশলী। প্রকৌশলী দেলোয়ার ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার তিন সন্তান স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেন, স্ত্রী গৃহবধূ। সত্যিকার অর্থেই পরিবারটি সহায়হীন হয়ে পড়ল।

আদালতে দেয়া ঘাতক শাহিন ও হাবিবের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে নির্মম হত্যাকাণ্ডের চিত্র। সহকারী প্রকৌশলী আনিছুর খুনের পুরস্কার হিসেবে শাহিনকে ৫ হাজার ও হাবিবকে ১০ হাজার টাকা দেন। এ ছাড়া একজন রিকশাচালকের মুঠোফোন দিয়ে টেলিফোন করার বিনিময়ে তাকে ১০০ টাকা দেন। সে ক্ষেত্রে আনিছুরের সাকল্য খরচ হয়েছে ১৫ হাজার ১০০ টাকা।

যেভাবে হত্যাকাণ্ড হয়েছে : প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যার ঘটনাটি ঘটে ১১ মে। মিরপুর ২ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত তার বাসা থেকে সকালে অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। দেলোয়ার হোসেন যে মাইক্রোবাসে অফিসে যান সেটি নিয়ে এসেছিলেন তারই সহকারী প্রকৌশলী আনিছুর রহমান। তার সঙ্গে ছিলেন ভাড়াটে খুনি শাহিন ও গাড়িচালক হাবিব। আনিছুর ও শাহিনের পরনে পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী) ছিল। করোনা সংকটের কারণে জরুরি সেবায় নিয়োজিত অনেকেই পিপিই ব্যবহার করেন। তাই কেউ তাদের সন্দেহ করেননি। গাড়িটি প্রকৌশলী দেলোয়ারের বাসার সামনে গাছের নিচে থামার আগে আনিছুর এক রিকশাচালকের মুঠোফোন থেকে তাকে কল করে নিচে আসতে বলেন। তার কাছে মুঠোফোন থাকা সত্ত্বেও সেটি ব্যবহার করেননি। প্রমাণ রেখে যেতে চাননি। তবে অপরাধী যতই চালাক হোন, মনের অজান্তেই প্রমাণ রেখে যান। আনিছুর যে রিকশাচালকের মুঠোফোন ব্যবহার করেছেন, সেই রিকশাচালকের সূত্র ধরে হত্যার রহস্য উদঘাটন করে পুলিশ।

ভাড়াটে খুনি শাহিনের জবানবন্দি অনুযায়ী, গাড়িটি রূপনগর বেড়িবাঁধে উঠতেই আনিছুর তাকে ইশারা দেন এবং তিনি (শাহিন) পেছন থেকে প্রকৌশলী দেলোয়ারের গলায় রশি পেঁচিয়ে টান দেন। এ সময় আনিছুরও তাকে হত্যার কাজে সহায়তা করেন। যখন তারা নিশ্চিত হলেন দেলোয়ার মারা গেছেন, তখন উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টরের একটি খালি প্লটে তার লাশ ফেলে চলে যান। পরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার নাবিদ কামাল বলেন, প্রযুক্তির সহায়তা ও সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, প্রকৌশলী দেলোয়ারকে মাইক্রোবাসে তোলার সময় এক ব্যক্তি সাদা সুরক্ষাপোশাক (পিপিই) পরা ছিলেন। আনিছুর প্রথমে দাবি করেছিলেন, ঘটনার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে বাসায় ছিলেন। বাসার ঠিকানাও ভুল দিয়েছিলেন তিনি। তার বাসার সামনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ১১ মে সকালে সাদা পিপিই ও কালো জুতা পরে তিনি বাসা থেকে বের হচ্ছেন। প্রকৌশলী দেলোয়ারকে যেখান থেকে মাইক্রোবাসে তোলা হয়, সেখান থেকে সংগ্রহ করা সিসিটিভি ফুটেজের দৃশ্যের সঙ্গে আনিছুরের বাসার সামনের ফুটেজের মিল রয়েছে।

এদিকে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বিভিন্ন প্রকল্পের বিল প্রদান নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ারের সঙ্গে তার সহকারী প্রকৌশলীদের দ্বন্দ্ব ছিল। দেলোয়ার অনেক ত্রুটিপূর্ণ কাজের বিল আটকে দেন। এতে তার সহকারী প্রকৌশলীরা ক্ষুব্ধ হন। তারা তাকে বিল দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। এই প্রেক্ষাপটে গত সেপ্টেম্বরে তাকে ওএসডি করা হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তকে সহকর্মীরা তাদের বিজয় হিসেবে মনে করেছিলেন। গত জানুয়ারিতে আবার তাকে কোনাবাড়ী অঞ্চলে পদায়ন করা হলে তারা ক্ষুব্ধ হন এবং এই হত্যাকাণ্ড তারই পরিণতি বলে ধারণা করা যায়। একজন সৎ প্রকৌশলী হিসেবে দেলোয়ারের সুনাম ছিল। এর আগে নারায়ণগঞ্জেও সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বলছেন, দেলোয়ার হোসেন সৎ কর্মকর্তা ছিলেন। সিটি করপোরেশনে নিম্নমানের উন্নয়নকাজ করায় তিনি বিভিন্ন ঠিকাদারের অন্তত শতকোটি টাকার বিল আটকে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কোনাবাড়ী এলাকায় এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ৩৩ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়। জাইকা, এডিবি ও আরও একটি দাতা সংস্থার নামে পৃথক বিল তৈরি করা হয়। অর্থাৎ মোট ৯৯ কোটি টাকার বিল করা হয়। একই কাজ পৃথক তিনটি সংস্থার নামে বিল উত্তোলনের বিষয়টি দেলোয়ার আটকে দেন। এ ছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় সুপেয় পানির লাইন স্থাপনে শত কোটি টাকার একটি বিল তিনি অনিয়মের অভিযোগে আটকে দেন। এই কারণেই শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং তা বাস্তবায়ন করে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন হত্যার বিচার ও খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শনিবার বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এক বিবৃতি দিয়ে বলছেন, ‘ঘুষের বিনিময়ে শতকোটি টাকার কাজের ফাইল ছাড়তে রাজি না হওয়ায় দীর্ঘ পরিকল্পনার পর নিজ গাড়িচালকের সহায়তায় প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে বলে তদন্ত সংস্থার অনুসন্ধানে জানা গেছে। এ ঘটনা একটি অশনিসংকেত।’ বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ও প্রকৌশলী ইনস্টিটিউশন হত্যার নিন্দা ও বিচার দাবি করেছে।

টাইমস/জেকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জুনের মধ্যেই ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী Mar 29, 2024
img
বাজারে বেড়েছে মাংসের দাম, সবজিতে স্বস্তি Mar 29, 2024
img
বিএনপির ৮০ ভাগ নিগৃহীত নেতাদের তালিকা দিতে হবে : ওবায়দুল কাদের Mar 29, 2024
img
জায়েদ খানের নায়িকা হচ্ছেন টালিউডের পূজা ব্যানার্জি Mar 29, 2024
img
বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর পৌনে ৪ কিলোমিটার দৃশ্যমান Mar 29, 2024
img
আজ ঢাকার বাতাস ‘অস্বাস্থ্যকর’ Mar 29, 2024
img
দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫ Mar 29, 2024
img
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে সর্বোচ্চ রেকর্ড Mar 28, 2024
img
দূষণের কারণে বছরে পৌনে ৩ লাখ বাংলাদেশির মৃত্যু Mar 28, 2024
img
আইএমএফের হিসাবে দেশের রিজার্ভ এখন কত, জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক Mar 28, 2024