প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য ও আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতাদের নামে ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে প্রতারণা করছে একটি অসাধু চক্র। তবে ওই চক্রের সন্ধানে মাঠে নেমেছে র্যাব। অবশেষে ওই চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রতারণার বিভিন্ন কৌশলসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছে র্যাব।
র্যাব জানায়, ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ও পরে নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে গুজব রটানো, নির্বাচনের পূর্বে নিরাপদ সড়ক চাই, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং সাম্প্রতিক গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের নামে বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ ছড়ানোর ঘটনাগুলো হরহামেশাই ঘটিয়ে আসছে সাইবার অপরাধীরা। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারবর্গসহ বিভিন্ন জাতীয় নেতাদের নামে ভুয়া আইডি খুলেও নানা অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ওই চক্রটি।
১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ এমপি স্বাক্ষরিত একটি প্রেস রিলিজ র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের দৃষ্টিগোচর হয়। ওই প্রেস রিলিজ থেকে জানা যায়, কিছু কুচক্রী মহল বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নাম ব্যবহার করে কিছু ফেইক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট/পেজ থেকে নানা রকম বিভ্রান্তিমূলক, মিথ্যা, বানোয়াট তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামে অফিসিয়ালি কোনো ফেসবুক পেজ নেই।
পরে র্যাবের সাইবার টহল দল বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে অনুসন্ধানে নামে। এক পর্যায়ে ওই প্রতারক চক্রের সন্ধান পায় র্যাব। এনিয়ে বুধ ও বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় রাজধানীর মগবাজার, ডেমরা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ ও সাভার থেকে মো. ওমর ফারুক (৩০), মো. সাব্বির হোসেন (২৪), মো. আল আমিন (২৭), মো. আমিনুল ইসলাম আমিন (২৫) ও মো. মনির হোসেনকে (২৯) গ্রেফতার করা হয়। পরে বৃহস্পতিবার দুপুরে তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানানোর জন্য সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে র্যাব।
এ সময় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, গ্রেফতারদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন মডেলের ১২ টি মোবাইল ফোন ও একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ অন্যান্য জাতীয় নেতাদের নামে-বেনামে ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট তৈরি ও ব্যবহার করে প্রতারণা করে আসছে এই চক্রটি। শুধু তাই নয়, তারা বিভিন্ন জাতীয় নেতাদের ছবি বিকৃত বা ব্যাঙ্গাত্মকভাবে ফেসবুকে পোস্ট ও আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় নেতাদের খাটো করার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এছাড়াও ফেসবুকে ভুয়া ও গুজবের আগ্রাসনের মাধ্যমে দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণকে উস্কানি দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করছে।
তিনি আরও জানান, ফেইক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও পেজ খুলে তাতে নিজেদের মোবাইল নাম্বার সংযুক্ত করে নিজেদের বিশেষ এজেন্ট দাবি করে প্রতারণা করে আসছে। তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার করে ভুয়া বা ফেইক ফেসবুক তৈরি করে সরকার বিরোধী প্রচার প্রচারণা, বিভিন্ন জাতীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিষেদাগারের মাধ্যম হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া, দেশী ও বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের অনলাইন সংস্করণকে বেছে নিয়েছে। এটা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে জানান র্যাবের ওই কর্মকর্তা।
কারা সেই প্রতারক:
প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে ফেইক আইডি ব্যবহারকারীদের পরিচয় সনাক্ত করেছে র্যাব। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মো. ওমর ফারুক (৩০)। সে মাগুড়া জেলার মোহাম্মদপুর থানার আকসারচর এলাকার বাসিন্দা মো. মোখলেস শেখের ছেলে। সে বর্তমানে সাভারের তালবাগের ব্লক-বি, বাড়ী নং-৩১/১ বাড়িতে বসবাস করেন।
র্যাব জানায়, মো. ওমর ফারুক গত ৪ বছর ধরে ফেসবুক ব্যবহার করেন। সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে ছয়টি, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামে একটি, আওয়ামী সমর্থক গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন জাতীয় নেতাদের নামে সর্বমোট ৩৬ টি পেজ ব্যবহার করেন। নিজ নামে তার ছয়টি ফেসবুক আইডি আছে। তিনি তার পরিচালিত সব ফেসবুক পেজ-এ তার ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করেছেন। ফেসবুক পেজের সুত্র ধরে নিজেকে দলের বিশেষ এজেন্ট দাবি করে সে।
এ ধারাবাহিকতায় সে আসন্ন সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনে মনোনয়ন প্রার্থীদের টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখায় এবং বিভিন্ন নারী নেত্রীদের ফোন করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার আহ্বান জানিয়েছিলে বলে জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।
মো. সাব্বির হোসেন (২৪)। সে বরিশাল জেলার কোতোয়ালী থানার ইন্নাকাঠি এলাকার বাসিন্দা মৃত আবদুর রহিমের ছেলে। সে বর্তমানে রাজধানীর ধলপুর ১৪ নং আউটফলের ডিএসসিসি স্টাফ কোয়ার্টারে বসবাস করে। সে পেশায় সাইবার কমিউনিকেশন এক্সপার্ট। তার নামে সন্ত্রাস দমন আইনে দুইটি ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে চারটিসহ মোট ছয়টি মামলা রয়েছে।
র্যাব জানায়, সাব্বির ইতিপূর্বে তারেক জিয়া সাইবার ফোর্স, দেশ নেত্রী সাইবার ফোরাম পেজ-এর এডমিন ছিলেন। সম্প্রতি সে অসৎ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে তারেক জিয়া সাইবার ফোর্স, দেশ নেত্রী সাইবার ফোরামের স্থলে শেখ হাসিনার পরামর্শ ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল নাম সংযোজন করে তাতে নিরাপদ সড়ক চাই ও কোটা সংস্কার আন্দোলনে উস্কানিমূলক ভিডিও পোষ্ট করে আসছেন। সাব্বির যে কোনো নতুন ইস্যুর আগমন হলেই তা সরকার বিরোধী অপপ্রচারে রূপান্তর করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে থাকে বলে জানায় র্যাব।
মো. আল আমিন (২৭)। সে রাজধানীর ডেমরা কলাপড়া এলাকার বাসিন্দা মো. মিজানুর রহমানের ছেলে। সে পেশায় বেসরকারী চাকুরীজীবী। সে সাইবার অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি পেজ-এর এডমিন।
র্যাব জানায়, আল আমিন প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য জাতীয় নেতাদের ছবি বিকৃত আকারে প্রকাশ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠান যেমন: বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী, পুলিশকে ঘিরে মিথ্যা তথ্য সন্নিবেশ করে তাতে ভুয়া ছবি সুপার এ্যানিমেশন মাধ্যমে ফেসবুকে পোষ্ট করে থাকেন।
মো. আমিনুল ইসলাম আমিন (২৫)। সে বরিশালের বানারীপাড়া থানার মহিষাপোতা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল লতিফের ছেলে। বর্তমানে সে রাজধানীর নয়াটোলা এলাকায় চেয়ারম্যান গলিতে বসবাস করে।
র্যাব জানায়, সে পেশায় ছাত্র এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট মোট চারটি ও ফেসবুক পেইজ তিনটি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের লোগো সংযোজন করে প্রজন্ম চেতনা ও স্পাই উদ্দিন নামে ফেসবুক পেজ রয়েছে তার। ওই পেজে সে গুজব ও আন্দোলন সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন উস্কানিমূলক ও কুরুচিপূর্ণ ভিডিও পোষ্ট করে ভাইরাল আকারে প্রচার করে।
মোঃ মনির হোসেন (২৯)। সে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানার ভাওয়াল মনহরিয়া এলাকার বাসিন্দা মৃত আব্দুল কাদিরের ছেলে। সে গত ৭/৮ বছর ধরে ফেসবুক ব্যবহার করে আসছেন। তার বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে কেরানীগঞ্জ থানায় বেশ ক’টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
র্যাব জানায়, মনির হোসেনের নামে তিনটি ফেসবুক আইডি ও চারটি পেজ রয়েছে। সে সত্যের বিস্ফোরণ নামে একটি পেজ-এর এডমিন। মনির হোসেন তার ফেসবুক আইডি ও পেজ থেকে রাজনৈতিক অপপ্রচার, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করে দেশে অস্থিরতা বিরাজের পাঁয়তারা করে বলে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।
টাইমস/ কেআরএস/এইচইউ