সৌদি-রাশিয়ার তেলযুদ্ধ, করোনাভাইরাস ও উন্নয়নশীল দেশের পরিণতি

বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে যে দুটি বিষয় মানবজাতির উপর প্রভাব ফেলছে তার একটি হলো করোনাভাইরাস (covid19) যা সরাসরি মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আরেকটি হলো সৌদি-রাশিয়ার তেলযুদ্ধ যা বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে এবং এর প্রভাব ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এসে পড়ছে।

করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবী জুড়ে এই পর্যন্ত মারা গেছে ১১ হাজারের ওপর মানুষ, অন্যদিকে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্য গত এক মাসে প্রায় ৫০ শতাংশ কমে ২৬ ডলারে এসে পৌঁছেছে। করোনার ভয়াবহতার কারণে অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়টি যদিও এই মুহূর্তে মিডিয়ার গুরুত্ব পায়নি তবে অচিরেই এটি নীতিনির্ধারকদের আরেকবার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যে সম্প্রতি তেল উৎপাদন নিয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়ায় মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই অপরিশোধিত তেলের দাম কমে ২৬ ডলারে এসে ঠেকেছে। রাশিয়া ও সৌদি আরবের মধ্যে তেল উৎপাদনের যে চুক্তি রয়েছে- জুন, ২০২০ পর্যন্ত সৌদি আরব চেয়েছিল মন্থর বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে সেই চুক্তি থেকে সরে এসে তেলের উৎপাদন আরো কমাতে। কিন্তু রাশিয়ার ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট পুতিন এসে সায় না দেয়ায় পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে সৌদি আরব উল্টো তেল উৎপাদন আরো বাড়িয়ে দেয়ায় অপরিশোধিত তেলের দাম কমে তলানিতে এসে ঠেকছে। ২০০৩ সালের পর অপরিশোধিত তেলের দাম এত কম আর কখনোই ছিলনা।

তেলের উৎপাদন কমানোর সৌদি প্রস্তাবে রাশিয়ার আপত্তির পেছনে রয়েছে বেশ লম্বা যুক্তি আর দীর্ঘ প্রস্তুতি। রাশিয়া চেয়েছে আমেরিকার শেল ওয়েল (shale oil) ইন্ডাস্ট্রিকে শায়েস্তা করে মার্কিন রিপাবলিকান নেতাদের কড়া বার্তা দিতে। রাশিয়ার এই ক্ষোভের পেছনে রয়েছে রাশিয়ার উপর আরোপিত কতিপয় মার্কিন অবরোধ। আবার একই ঢিলে সৌদির ক্ষমতাধর তরুণ প্রিন্স সালমানকে বাগে আনাও রাশিয়ার আরেক কৌশল। সৌদি-আমেরিকান জোটের কারণে সিরিয়ায় রাশিয়াকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে, লিবিয়াতেও বেগ পেতে হচ্ছে।

রাশিয়া হিসেব কষে দেখেছে তেলের দাম ২৫ ডলারে নামলেও তাদের যে ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের সোভেগইন অয়েলথ ফান্ড (sovereign wealth fund) আছে তা দিয়ে আগামী পাঁচ বছরের বেশী টেক্কা দেয়া যাবে। আবার অন্য দিকে সিরিয়া, ভেনেজুয়েলার তেলের ভাণ্ডারও রাশিয়ার করতলে এসে গেছে ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতির কারণে। এমন পরিস্থিতিতে অদূরদর্শী প্রিন্স সালমানের সৌদি আরবও সহজে হার মেনে না নিয়ে রাশিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে তেলের দাম কমেই চলেছে। সৌদি রাজপরিবারের সদস্যরা যদিও জোর গলায় বলছেন তেলের দাম ২০ ডলারে নামলেও তাদের কোন সমস্যা হবেনা তবে এটি আদতে কথার কথা কিনা বলা মুশকিল। সৌদিকে বাঁচাতে তাদের একমাত্র ভরসা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য ইতোমধ্যেই এগিয়ে এসেছেন। পুতিনকে চাপে ফেলতে রাশিয়ার উপর নতুন করে অবরোধ আরোপের হুশিয়ারি দিয়েছেন ট্রাম্প।

সৌদিআরব তথা মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের অর্থনীতি বহু বছর ধরেই তেল নির্ভর। এখানে কাজ করে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর লাখ লাখ জনশক্তি। তেলের দাম কমে গেলে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের রেমিটেন্সে আঘাত আসবে, ফলশ্রুতিতে দেশের অর্থনীতি হোঁচট যে খাবে তার প্রমাণ ইতোমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্যানুযায়ী ডিসেম্বর, ২০১৯ সালে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ১৪৩ বিলিয়ন টাকা, যা ১৪ শতাংশ কমে ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১২৩ বিলিয়ন টাকা। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আগামী মাসগুলিতে এর ব্যাপক প্রভাব গ্রামীণ অর্থনীতিতে দেখা দিবে।

করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউরোপের উন্নত দেশগুলি। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের আমদানিকারক মূলত ইউরোপের এই উন্নত দেশগুলো। অন্যদিকে বিজিএমইএ’র দেয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪.২১ শতাংশ এসেছিল পোশাক শিল্প থেকে যার পরিমাণ ছিল ৩৪.১৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এসে এমনিতেই আগের চেয়ে ক্রয়াদেশ কমেছে পোশাক শিল্পে। ফলে করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নতুন করে ক্রয়াদেশ হারালে তা নিশ্চিতভাবেই বৃহৎ পরিসরে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এমনিতেই মুদ্রাপাচার হয়ে যায় প্রভাবশালীদের হাত ধরে যা অর্থনীতিকে দুর্বল করে ফেলে।

এমন বিশ্ব পরিস্থিতিতে উপরন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনশক্তি আর পোশাক শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা কাটিয়ে উঠা সত্যিই কঠিন হবে, তদুপরি সমাজে স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হওয়ারও আশংকা রয়েছে।

আসন্ন এমন পরিস্থিতিতে যদি কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে হাজির হয় তবে তা ফুড সিকিউরিটিতেও আঘাত হানবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেলে যে পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি থাকা উচিত সকলের।

 

লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

 

 

Share this news on: