জীবাণুনাশক টানেলের ব্যবহারে বাড়তে পারে স্বাস্থ্যঝুঁকি!

ভাইরাসে সংক্রমণ ঠেকানোর লক্ষ্যে গত ১৬ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে করোনা জীবাণুনাশক টানেল ব্যবহার ও মানব দেহে ক্ষতিকর রাসায়নিক জীবাণুনাশক ছড়ানো বন্ধে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্দেশনায় এ ধরনে জীবাণুনাশক টানেল ব্যবহার যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) গাইডলাইন অনুযায়ী বিধিবদ্ধ নয় তা স্পষ্ট করা হয়। অথচ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জীবাণুনাশক টানেল স্থাপন ও ব্যবহার করে চলছে।

অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনায় সরকারি অফিসে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে জীবাণুনাশক টানেল স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের শহরের বিপনিবিতান গুলোর জন্য করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে দেয়া স্বাস্থ্যবিধি নির্দেশনায় এ ধরনের টানেল নির্মাণের বিষয়টি স্থান পেয়েছে। অথচ এই জীবাণুনাশক টানেলে কি ধরনের রাসায়নিক ব্যবহৃত হবে এবং তা কার্যকরি কিনা এ বিষয়টি স্পষ্ট নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বিধায় ব্লিচিং পাউডারের বন্ধের বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হয়। এ ধরনের টানেলে জীবাণুনাশক ব্যবহার কোন স্বীকৃত গাইডলাইন না থাকায় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রবণ ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ সহজলভ্য রাসায়নিক জীবাণুনাশকের মধ্যে ব্লিচিং পাউডার ও হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বেশি ব্যবহৃত হয়। এ দুটি রাসায়নিকই যে ঘনমাত্রায় জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয় তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের এন্টি ব্যাকটেরিয়াল সল্যুশন (ডেটল, সেভলন) পানিতে মিশিয়ে জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু এ সকল মিশ্রণের ভাইরাস/কোভিড-১৯ নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম কিনা তার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। কেউ কেউ আবার জীবাণুনাশক টানেলে ব্যবহার করছে গরম বাষ্প।

রাসায়নিক জীবাণুনাশকের কার্যকারিতা মূলত নির্ভর করে মিশ্রণে উপস্থিত রাসায়নিকের ঘনমাত্রা ও আরোপিত সময়ের উপরে। সঠিক ঘনমাত্রা ও পর্যাপ্ত সময় না পেলে এ সকল মিশ্রণ ভাইরাস/অন্যান্য জীবাণু নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (CDC) কর্তৃক রাসায়নিক জীবাণুনাশক ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন ও নির্দেশনা দেয়া আছে। তবে ঐ রাসায়নিকগুলো মানবদেহে সরাসরি ব্যবহারের জন্য নয়, এর ব্যবহার মূলত মেডিকেল ও সার্জিক্যাল মেটেরিয়াল, পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই) এর জীবাণুনাশ ও স্টেরাইল করতে। সেখানে জীবাণুনাশকের ব্যবহার বিধি, মিশ্রণে রাসায়নিকের ঘনমাত্রা ও প্রয়োজনীয় সময় যথাযথ উল্লেখ আছে।
উদাহরণস্বরূপ- হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নেয়া যেতে পারে যা বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য জীবাণু নিষ্ক্রিয় করনে বেশ কার্যকরী। CDC-এর তথ্য অনুযায়ী, ৩% ঘনমাত্রার হাইড্রোজেন পার অক্সাইড দ্রবণের সেরোটাইপ রিনোভাইরাস নিষ্ক্রিয় করতে সময় লাগে ৬-৮ মিনিট। ঘনমাত্রা কম হলে সময় আরো বেশি লাগবে (১.৫% ঘনমাত্রার জন্য ১২-২০ মিনিট, ০.৭৫% ঘনমাত্রার জন্য ৫০-৬০ মিনিট )।

দেশের অধিকাংশ জীবাণুনাশক টানেলে অতি অল্প সময়ে (৩-৫ সেকেন্ড) যে জীবাণুনাশক রাসায়নিক মিশ্রণ ব্যবহৃত হচ্ছে তার কার্যকারিতা অনেকটায় প্রশ্নবিদ্ধ। এত অল্প সময়ে এটি যে কোন ভাইরাস/কোভিড-১৯ কে নিষ্ক্রিয় করতে পারবে তারও কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। উল্টো এটি মানুষের মনে স্বাস্থ্যসুরক্ষার একটা মিথ্যা আশ্বাস বা ‘ফলস সেন্স অফ সেফটি’ সৃষ্টি করতে পারে।

আবার যে বিষক্রিয়ার কারণে এই রাসায়নিক মিশ্রণ সকল জীবাণু নিষ্ক্রিয় করে, ঐ একই বিষক্রিয়া মানবদেহেরও ক্ষতি করতে পারে। অধিকাংশ রাসায়নিক জীবাণুনাশক মানুষের ত্বক, চোখের সংস্পর্শে আসলে অথবা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ- ৩% ঘনমাত্রার হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের সেফটি ডাটা শিট বিশ্লেষণ করলে দ্রবণটির স্বাস্থ্যঝুঁকির মাত্রা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এই ঘনমাত্রার হাইড্রোজেন পার অক্সাইড দ্রবণটি বিপদজনক, এটি চোখের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে (ক্যাটাগরি-১), পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও ত্বকে লাগলে দ্রুত পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। পোশাক ও জুতা দ্রুত সাবান পানি দিয়ে পরিষ্কার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বাষ্প বা বাষ্পকণা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। CDC-এর তথ্য অনুযায়ী, বায়ুতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এর অনুমোদিত মানমাত্রা সীমা ১ পিপিএম (permissible exposure limit 1 ppm), জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মানমাত্রা সীমা ৭৫ পিপিএম (NIOSH, ILDH 75 ppm) ও স্বল্প সময়ের জন্য অনুমোদিত মানমাত্রা সীমা ৩ পিপিএম (OSHA, STEL 3 ppm)।

জীবাণুনাশক টানেলে ৩% ঘনমাত্রার হাইড্রোজেন পার অক্সাইড অথবা ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহৃত হলে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে কয়েটি বাষ্পকণা ফুসফুসে প্রবেশ করলেই এর মানমাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ সীমা অতিক্রম করতে পারে। তাই এ ধরনের রাসায়নিক জীবাণুনাশক টানেলের ব্যবহার মানুষের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।

তাই স্বাস্থ্যঝুঁকি ও জীবাণুনাশক টানেলের কার্যকারিতা বিবেচনায় অবিলম্বে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী সকল জীবাণুনাশক টানেলের ব্যবহার বন্ধে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অতীব জরুরী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন ও পরামর্শ মেনে সাবান পানি দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া অথবা এলকোহল যুক্ত স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করা, অপরিষ্কার হাত চোখে/মুখে না লাগানো, মাস্ক ব্যবহার করা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কেমিকৌশল বিভাগ, বুয়েট

Share this news on: