কুয়েত মৈত্রী হসপিটাল থেকে লিখছি: করোনার সাথে বসবাস (শেষ পর্ব)

৫ জুলাই সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রান্তিককে ফোন দিলাম। প্রান্তিক জানালো- লাশবাহী গাড়ি আসলে সে ফোন দিবে। আমি ঝটপট নাস্তা করে ঘরের কাজগুলো সেরে নিলাম। সাড়ে ১০টায় প্রান্তিক ফোন দিলো। আমি তখন আব্বাকে নিয়ে ওয়াশরুমে যাচ্ছি। আব্বাকে ফ্রেশ করিয়ে ঝটপট নিচে নেমে গেলাম। গেইটে সিকিউরিটি আটকাতে চাইলো, আমি বললাম আমার বোনের হাজব্যান্ডকে বিদায় দিতে হবে। সিকিউরিটি আর আটকালো না। নিচে নেমে দেখি প্রান্তিকরা প্রায় বিদায় নিচ্ছে। কোনভাবে এম্বুল্যান্সের ভিতর থেকে দুলাভাইয়ের প্যাকিং করা নিথর দেহটা দেখে প্রান্তিক আর তার বোন নওরিনকে বিদায় দিলাম। বছর ছয় আগে প্রান্তিকের মা ডলি আপা বিএসএমএমইউতে পরলোক গমন করেন। তখন উনাকে দাফন করার জন্য নওরিন, প্রান্তিকের সাথে নালিতাবাড়ি পর্যন্ত যাবার সুযোগ হয়েছিলো। এবার পরিস্থিতি এমন যে নিজে সপরিবারে হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় প্রান্তিকের আব্বুকে বিদায় দিতে হলো।

উপরে এসে ফ্রেশ হলাম। আব্বা চুপচাপ, রুমের মাঝে থমথমে অবস্থা। আব্বা সারাদিন কারও সাথে তেমন কথা বলেননি। এখন আব্বার পেটের পীড়াটা একটু ঠিক হয়েছে। অন্যরাও একটু একটু স্ট্যাবল হচ্ছে।

নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ। এক এক জনের মন এক এক রকম। একজনের নাম জালাল, শক্ত সামর্থ্য মাঝ বয়সী। সারাদিন ওয়াশরুমে দৌড়াদৌড়ি করেন, ইন্টারেস্টিং চরিত্র। সারাক্ষণ বাথরুম পরিষ্কার করেন। পাশের রোগীদের সহযোগিতা করে। বেশীরভাগ সময় তাকে ধোয়া-মোছাতেই ব্যস্ত থাকতে দেখি। উনার বেড ওয়ার্ডে না বাথরুমে তা বুঝা মুশকিল।

হাসপাতাল জীবনে এই প্রথম কাউকে অন্যের ওয়াশরুম ধোয়া মোছা করতে দেখলাম। দেখা হলে বলে- গত কয়ডা মাস সব ধুয়ে ফেললাম কিন্তু লাভ কি? আইতেই হইলো। বলতে বলে আবার ধুতে থাকে।

একদিন সারাদিন তার খোঁজ নেই, বিকেলে বাথরুমে দেখা। বলল- ‘শরীরটা দুর্বল, তাই আজ ধুইতে পারিনাই। ডাক্তারকে বললাম সবাইরে স্যালাইন লাগাইয়া দিছেন, আমারেও দেন। ডাক্তার হাসে, এগুলার নামে বাসায় যাইয়াই ফেইসবুকে লিইখা ভইরা ফেলামু।’ আমি হাসি উনার কথা শুনে।

একটু পর রুমে এসে বলল আপনার প্রেশার মাপার যন্ত্র আছে? আমি বলি কেনো? জালাল সাহেব বলল শরীর দুর্বল তাই তিনটা ডিম লবণ দিয়া খাইয়া ফেলছি। লবণ দিয়া এক গ্লাস পানিও খাইছি, এখন প্রেশার বাইরা গেছে। আমি বললাম লেবু চিপে খেয়ে ঘুমিয়ে থাকেন। প্রেশার ঠিক হয়ে যাবে। আর ডিম লবণ দিয়ে খাবেন না। শুধু দুইটা ডিমের সাদা অংশটুকু খাবেন।

এখানে এভাবেই দিন কাল চলছে। মীমের শরীরটা এক একদিন এক এক রকম। কখনো বুকে ব্যথা, কখনো জ্বর, মাথা ব্যথা ইত্যাদি। আব্বার পেটের সমস্যা ব্যতীত সব ঠিক আছে। সব কিছু নিয়মিত চলছে। ডাক্তার, নার্স, ক্লিনার সময় মত তাদের কাজ করে যাচ্ছে। ফুফু আর বোন নিত্য নতুন নানা রকম খাবার পাঠাচ্ছে। এবার মেঝো বোন খাবার দিতে পারছেনা কারণ তার বাসা ধানমন্ডি কলাবাগান, এই জন্য তার কষ্টের সীমা নেই।

আগারগাঁও নিউরো সাইন্স হাসপাতালে যখন আম্মাকে নিয়ে এক মাস ভর্তি ছিলাম, তখন মেঝো বোন প্রতিদিন কষ্ট করে খাবার নিয়ে যেতো। তখন বড় বোন কান্নাকাটি করতো। ওইবারতো আম্মাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ হবার পর মেঝো বোন কষ্টে কান্না জুড়ে দেয়। এতদিন নাকি আম্মা তার কাছে ছিলো। প্রতিদিন দেখা হতো। এখন চলে যাচ্ছে আর দেখা হবে না তাই খারাপ লাগছে। মা বাবা হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে রিলিজ পেলে এই ধরনের খারাপ লাগার অভিজ্ঞতা আমার বোনদের আছে।

আস্তে আস্তে হাতে সময় বাড়তে লাগলো। এতদিন যারা যোগাযোগ করেও পায়নি তাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করলাম। ফুফু, মামা, ফুফাতো, চাচাত ভাই বোনদের সাথে যোগাযোগ করলাম, তারা প্রতিদিন ফোন দিয়ে খোজ নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইয়েরাও অনেকে ফোন দিয়েছিলো। তাদের সাথেও যোগাযোগ করলাম। প্রত্যেকই কোনো সমস্যা হলে তাদের জানাতে বলেছেন। অনেকেই খাবার পাঠাতে চায়, সবাইকে হাতে পায়ে ধরে ঠেকাতে হয়। এর মাঝখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদিক হাসান মনন ভাই এক ডিগ্রী উপরে। সে ভর্তি হবে বলে আমার কাছ থেকে আমার রুম বেড নাম্বার নিয়ে কৌশলে গেইটে শুকনো খাবার পার্সেল করে যায়।

এভাবে ১০ দিন পার হয়ে গেলো। কখনো ভালো কখনো মন্দ। আব্বার কন্ডিশন স্থির। দিনে কয়েকবার টয়লেট আর দুর্বলতা। আমেনাও ভালোর দিকে, কিন্তু মীম প্রতিদিন করোনার নানা উপসর্গে ভোগতে থাকে। কখনো মাথা ব্যথা, কখনো বুকে ব্যথা, মাথা ঝিমঝিম করা, দুর্বলতা, জ্বর।

ডাক্তার এসে ভিজিট করে নিয়মিত। ডিরেক্টর ডাক্তার সারোয়ার সাহেব প্রায় ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নেন, সমস্যা থাকলে জানাতে বলেন, সুপারেন্ডেন্ট সিহাব সাহেবতো সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করতেই থাকেন, ডাক্তার রহিম সাহেবও ডিউটিতে এসে খোঁজ নিয়ে যান। মীম তার সমস্যার কথা বললে তারা কিছু ব্যবস্থা নেয় আর বলে এগুলো উপসর্গ হবে আবার ভালো হবে কোনো চিন্তা করবেন না।

মীমের বুকের ব্যথার জন্য তার সিটিস্ক্যানও করানো হয়। তাদের মূল দেখার বিষয় শ্বাসকষ্ট হয় কিনা কিংবা অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক আছে কিনা? এই দুইটা না থাকলে তারা আর বেশী চিন্তা করেনা।

এখন করিডোরে একটি অভিযোগ বক্সও রাখা হয়েছে। আমার কোনো কিছু প্রয়োজন পড়লে কন্ট্রোল রুমে জানিয়ে দেয়। তারা ব্যবস্থা করে তাই অভিযোগ নেই, তবে কিছু পরামর্শ রয়ে গিয়েছে। কন্ট্রোল রুম আর নার্স স্টেশনের মাঝে কিছু সমন্বয়হীনতা আছে। নার্সরা ওষুধ আর ইনজেকশন দেবার কাজটা ভালো মত করে কিন্তু রোগী অনুযায়ী ওষুধের প্যাকেটে ওষুধ ও নির্দেশিকায় মাঝে মাঝে ভুল হতে পারে। একটা ওষুধ পূর্বে কয় ডোজ খেলাম আর এখন কয় ডোজ দিলো সেটা মিলিয়ে নিতে হয়। সবচেয়ে ভালো একটা নোটবুক আর কলম রাখা। ওষুধের আর ডোজ গুলো লিখে রাখা। পূর্বে ও পরে সমন্বয়হীনতা দেখলে ডাক্তারকে জানানো। অনেক সময় ভুল ওষুধ আসতে পারে বা অন্য রোগীর ওষুধ প্যাকে চলে আসতে পারে। তাই সবকিছু নিজে যাচাই করে নেওয়া ভালো। এখানে সবাই সার্বক্ষণিক পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, প্রটেক্টেড চশমা পড়ে থাকে, তার উপর সিনথেটিক স্টিকার লাগানো থাকে। অবস্থাটা এমন যে উনারা অনেকে এ সকল প্রোটেকটেড পোশাকের জন্য অনেক কিছু দেখতে পায় না বা ঘোলাটে দেখে, কানেও একটু শব্দ কম শোনে। তাদের এসকল সীমাবদ্ধতা শেষেও তারা চেষ্টা করে।

নার্সরা প্রতিদিন ডিউটিতে শুধু ওষুধ আর ইনজেকশন নিয়ে আসে। কিন্তু অনেক রোগীর হাতে ক্যানোলা লাগানো, সেগুলো চেঞ্জ করতে হতে পারে বা নতুন সিনথেটিক স্টিকার লাগাতে হতে পারে সেই প্রস্তুতি তারা নিয়ে আসেনা। এমন কি রোগী রিলিজ হবার দিন সকালেও তারা তা খুলে দিয়ে যায়না। টুকটাক কিছু বিষয় সমন্বয় হয়তো হয়ত হয়ে যাবে।

১৪ জুলাই আমাদের করোনা টেস্ট করানো হয়, মাঝখানে একটা দিন উৎকণ্ঠায় কাটে। সবার টেস্ট রেজাল্ট ভালো না হলে হসপিটালে বসবাসের সময় বেড়ে যাবে আবার এক এক জনের এক এক রকম হলেও সমস্যা। আব্বা এবং মীমকে নিয়েই ভয়। দুইজনের শরীরেই কোনো না কোন সমস্যা রয়ে গিয়েছে। আব্বা বাড়ি যাবার জন্য সকল পরিকল্পনা শুরু করেছে। আমার তেমন চিন্তা নেই। আমার চিন্তা একজনের রেজাল্ট নেগেটিভ আসলে তাকে নিয়ে বাকী দিন কীভাবে কাটাবো সেটা নিয়ে। ওয়ার্ড ছেড়ে এবার কেবিনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাইহোক এসব উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মাঝেই ১৫ তারিখ দুপুরে খাবার সময় সবাইকে আলাদা আলাদা ফোন করে জানালো সবার রেজাল্ট নেগেটিভ। আসর শেষে শুকরিয়া নামাজ আদায় করলাম। ডিরেক্টর ডাক্তার সারোয়ার সাহেব এবং শিহাব সাহেবকে জানালে অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে আমরা যেতে পারি বলে জানান। পরিবার ও কানেকটিং মানুষগুলোর সাথে যোগাযোগ করি। আব্বা ও আমি সিদ্ধান্ত নেই কাল সকালে হাসপাতাল ছাড়বো। এবার সব প্যাকিং করে গুছিয়ে নেবার পালা।

১৭ জুলাই সকাল থেকে নাস্তা করে আমরা যাবার প্রস্তুতি নিলাম। ক্লিনার সূবর্ণা এসে বিদায় নিয়ে গেলো। সকাল থেকে গফরগাঁও থেকে গাড়ি এসে প্রস্তুত। দুপুর ১২টায় ওয়ার্ডবয়রা রিলিজ অর্ডার নিয়ে আসলো। করোনা রোগীকে ভর্তি এবং রিলিজের ওয়ার্ডার নিতে কোনো দৌড়াদৌড়ি করতে হয়না। কন্ট্রোল রুম থেকে প্রেসক্রিপশন, রিপোর্ট আর রিলিজ ওয়ার্ডার তারা রুমে পৌছে দেয়। সকল মালামাল একটা ট্রলিতে করে নিচে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসলো।

যাত্রা শুরু হলো। নতুন পথের যাত্রা। যাত্রা পথে মস্তিষ্কের শিরা উপশিরাগুলো আবার ভাবনার জাল বোনতে থাকে। করোনা অনেক মানুষের কাছে আমাকে খুব বেশী ঋণী করে ফেলেছে। এই ঋণ শোধ করবো কি করে? কয়েক জনম লেগে যাবে তাও হয়তো পারবোনা। আমার কি-বা ক্ষমতা! অর্থের ঋণ তো শোধ করা যায় কিন্তু ভালোবাসার ঋণ সে কি করে পরিশোধ হয়?

করোনা পরবর্তী জীবন কেমন হবে তা নিয়ে আমরা অনিশ্চিত। করোনা নেগেটিভ একটি সার্টিফিকেট মাত্র, কিন্তু করোনার প্রভাব শরীরে কীভাবে বিস্তার করবে তা আমরা জানিনা। একটা নতুন ভাইরাস, যা কিনা একটি পুরোদুস্তর আধুনিক বিশ্বকে নাকানি চুবানি খাইয়েছে সেটা মোটেও ফেলনা কিছু না। আণবিক বোমা যেমন হিরোশিমা নাগাসাকিকে শুধু ধ্বংসই করেনি বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ভুগিয়েছে। ঠিক এই ভাইরাস মানুষের শরীরের উপর কোন কোন প্রভাব বিস্তার করবে তা আমরা জানিনা। করোনা পরবর্তী দেশীয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ব্যবসা, বাণিজ্য, অর্থনীতি, মানুষে মানুষে আচরণ সব কিছু যে পরিবর্তন হবে এবং হচ্ছে তা আমরা দেখতে পারছি। ভবিষ্যতটাও আন্দাজ করতে পারছি। আমেরিকার টুইন টাওয়ার হামলার পর যেমন গত দুই দশক পশ্চিমা দেশগুলো এক নয়া শাসন, নয়া অর্থনীতির জন্ম দেয়। ঠিক এই করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বে এক নয়া অর্থনীতি, রাজনীতির জন্ম দিবে যার নিয়ন্ত্রণ হয়তো পশ্চিম থেকে পূর্বের হতে যাবে। কিন্তু মানুষের শরীরে এর কি প্রভাব পড়বে বা এই নয়া বিশ্বে মানুষকে কতটা চড়া মূল্য দিতে হবে তা হয়তো জানতে আরও কিছু সময় প্রয়োজন হবে। ততদিন আমরা থাকবো অনিশ্চিত অশেষ যাত্রা পথে।

আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন সুস্থতা, অসুস্থতা দুইটাকেই তার বান্দার জন্য নেয়ামত হিসাবে দিয়েছেন। তাই আমাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়াতে আমি নেয়ামত হিসেবেই গ্রহণ করেছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের মঙ্গলের জন্যই পরিকল্পনা করেছেন। আর আমরা যা চাই তা উনি দেননি বরং আমাদের যা প্রয়োজন তাই উনি দিয়েছেন।

লেখক: ডিরেক্টর, ডেলটা হেলথ কেয়ার, যাত্রাবাড়ী লি.

কুয়েত মৈত্রী হসপিটাল থেকে লিখছি: করোনার সাথে বসবাস (পর্ব-৫)

Share this news on:

সর্বশেষ

img
রাজসিক সংবর্ধনায় দায়িত্ব নিলেন বিএসএমএমইউ'র নতুন উপাচার্য Mar 28, 2024
img
রোদে পোড়া ত্বকের যত্নে হলুদের ঘরোয়া প্যাক Mar 28, 2024
img
শহরের চেয়ে গ্রামে বিয়ে-তালাক বেশি Mar 28, 2024
img
ময়মনসিংহে বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৫ Mar 28, 2024
img
বাংলাদেশে মুক্ত গণতন্ত্র বাস্তবায়নে সমর্থন অব্যাহত থাকবে: ম্যাথিউ মিলার Mar 28, 2024
img
নিউইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত Mar 28, 2024
img
নিষেধাজ্ঞার ৩ দিনের মধ্যে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রস্তাব অনুমোদিত Mar 27, 2024
img
জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া উচিত বিএনপির : কাদের Mar 27, 2024
img
‘তুফান’এর পোস্টার প্রকাশ, গ্যাংস্টার রূপে আসছেন শাকিব খান Mar 27, 2024
img
বিএনপির মন্ত্রীদের বউরা ভারত থেকে শাড়ি এনে বিক্রি করত : প্রধানমন্ত্রী Mar 27, 2024