সাইকেল মেকানিক থেকে মেডিকেলের স্বপ্নজয়ের গল্প

আমার বাবা একজন সাইকেল মেকানিক। তার শখ ছিলো আমাকে ট্রাক-বাস এর মেকানিক বানাবেন। এবং তিনি এ ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তাই সিদ্ধান্ত হলো ক্লাস ফাইভ পাশ করার পর আমাকে ঢাকায় বাবার পরিচিত এক গ্যারেজে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমি ব্যাপারটা মেনে নিয়েই সেরকম প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

আমি সকাল ৭টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত স্কুল টাইম ছাড়া বাকি সময়ে বাবার দোকানে কাজ করতাম। দোকানে কাজ করতাম আর সময় পেলে কালি মাখা হাতে বই খুলে পড়তাম। এভাবে আমার বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা কালিতে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল। আমি ক্লাস ৮ পর্যন্ত জানতামও না, কেনো পড়ছি। দোকানে কাজের ফাঁকে পড়লে লোকজন আমাকে আদর করতো, উৎসাহ দিতো এজন্যই পড়তাম।

এভাবে পড়েই ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষায় পাঁচবিবি থানায় সাধারণ গ্রেডে ৪১ তম হই। এই সাফল্যে আত্মীয়স্বজন, এলাকার লোকজন আমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বাবাকে বাধ্য করেন। তখন বাবা আমাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার অনুমতি দেন। তারপর গ্যারেজে যেতে হবে এই শর্তে পাঁচবিবি এলবিপি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই।
নতুন স্কুলে ১ম সাময়িক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের পর সবাই আমাকে একটু একটু চিনতে লাগলো। দোকান আর স্কুলেই সময় কাটতো আমার। দুপুরে খাওয়া এবং রাতে ঘুমানোর জন্য বাসায় যেতাম শুধু। "খেলাধূলা" শব্দটা শুধু শুনতাম তখন। সে সুযোগ আর হয়ে উঠতোনা।

JSC পরিক্ষায় পাঁচবিবি থানায় ৬ষ্ট স্থান অধিকার করে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলাম। তারপর থেকেই বাবা আমাকে পড়াশোনার পুরোপুরি সাপোর্ট দিতে শুরু করলেন। কিন্তু নিজের খরচ নিজেই দোকানে কাজ করে চালাতাম। বাবার অনুমতি আর মায়ের ভালোবাসা নিয়ে SSC পরিক্ষায় GPA 5 এবং পাঁচবিবি থানায় ২য় স্থান অধিকার করে ভর্তি হলাম রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে।

কলেজে থাকাকালীন সময় থেকেই বড় ভাইদের দেখে মেডিকেলের জন্য প্রিপারেশন নিতে শুরু করলাম। বাবাকে বিষয়টা জানালে বাবা এমনভাবে প্রচার করলেন, সবাই ভাবলো আমি অনেক বড় ডাক্তার হয়ে গেছি। তারপর এডমিশনের সময়ে ভর্তি হলাম রাজশাহী রেটিনায়। কোচিংয়ে মোটামোটি রেজাল্ট আসলেও কখনোই নিরাশ হতাম না। আমি স্থির করে নিয়েছিলাম যে মেডিকেলে চান্স পেতেই হবে। তার জন্য সর্বোচ্চ পরিশ্রম করেছিলাম। তারপর সেই শুভক্ষণ। ২০১৬ সালের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ৪২২ তম স্থান অধিকার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম।

আমার আত্মীয় স্বজন সবাই চায় হার্টের ডাক্তার হই। তাই আমারও ইচ্ছা দেশসেরা cardiac surgeon হবো। আমার সৃষ্টিকর্তা এবং বাবা মায়ের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা আমাকে এতোদূর নিয়ে আসার জন্য। তাদের ভালোবাসা নিয়েই বাকিপথ পাড়ি দিতে চাই।
দারিদ্রতা কখনো আমার পড়ালেখায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আমার পড়ালেখার প্রধান অন্তরায় ছিলো বাবার মেকানিক বানানোর ইচ্ছাটাই।

"আব্বা, আমি হয়তো বাস-ট্রাকের মেকানিক হতে পারিনি, কিন্তু মানুষের মেকানিক হতে যাচ্ছি"

 

লেখক : মো: মিনহাজুল ইসলাম
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ।
কার্টেসি : Humans of Suhrawardy

 

টাইমস/জেকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সারাদেশে ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট জারি Apr 19, 2024
img
বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীদের তালিকায় আলিয়া Apr 19, 2024
img
পালিয়ে আসা ২৮৫ জনকে ফেরত নিচ্ছে মিয়ানমার: পররাষ্ট্রমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
গ্রেপ্তারি পরোয়ানার শঙ্কায় নেতানিয়াহু, ইসরায়েলে জরুরি বৈঠক Apr 19, 2024
img
পালিয়ে বাংলাদেশে এলেন আরও ১১ বিজিপি সদস্য Apr 19, 2024
img
কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন শেখ হাসিনা Apr 19, 2024
img
প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন : অর্থমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে গেল বাস, প্রাণ গেল প্রকৌশলীর Apr 19, 2024
img
চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি Apr 19, 2024
img
৩টি ড্রোন ধ্বংস করল ইরান, ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনা নিরাপদ Apr 19, 2024