ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল হলে ভবিষ্যৎ কী?

নাগরিকত্ব প্রতিটি মানুষের সাংবিধানিক ও মৌল-মানবিক অধিকারের অংশ। তাই কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিকের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার পূর্বে অবশ্যই তাকে ভাবতে হবে যে, ওই নাগরিক রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক হয়ে যাচ্ছেন কিনা। কেননা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্রই এমন কোন নাগরিকের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে পারেনা, যেন ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে।

বিগত কয়েক বছরে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের নাগরিকরা আইএসে যোগ দিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি সিরিয়ায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছে আইএস। ফলে তারা আজ পরাজয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এমতাবস্থায় আইএস যোদ্ধা এখন নিজ নিজ দেশে ফিরতে ইচ্ছুক।

 

কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ফিরতে ইচ্ছুক এই নাগরিকদের ফেরত নিতে চায় না। এজন্য জার্মানি, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের দেশগুলো যুদ্ধ ফেরত আইএস যোদ্ধা নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় এসব নাগরিকদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে যদি কোনো রাষ্ট্রই আইনসিদ্ধ নাগরিক বলে বিবেচনা না করে, তবে সেই ব্যক্তি রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক বলে বিবেচিত হবেন। কিন্তু সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, বিশ্বের প্রতিটি মানুষেরই কোনো না কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাবার অধিকার রয়েছে। তাই কোনো ব্যক্তিকেই তার নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

১৯৮১ সালের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী দেখা যায়, জন নিরাপত্তা বিধান ও সুরক্ষার স্বার্থে যে কারো ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করার ক্ষমতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রয়েছে। তবে তার আগে নিশ্চিত হতে হবে, যার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হচ্ছে ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ছেন কিনা।

এছাড়া ব্রিটেনের ‘ইমিগ্রেশন, অ্যাসাইলাম অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট-২০০৬’ আইনেও বলা আছে কেবল দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক ও যুক্তিযুক্ত কারণ সাপেক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কারো নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারেন। অর্থাৎ দেখা যায় মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ও ব্রিটিশ নাগরিকত্ব আইন দুটিতেই নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ছেন কিনা তা বিবেচনা করা হয়েছে।

তাছাড়া ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী, যারা কেবল ব্রিটিশ নাগরিক, তাদের সেই অধিকার কেড়ে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে দ্বৈত নাগরিকদের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার শতাধিক নজির রয়েছে।

কিন্তু দেখা যায় যে, এই দুটি আইন থাকার পরও যুক্তরাজ্য সরকার এমন অনেকের নাগরিকত্ব কেড়ে নিচ্ছে, যারা রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হল- আইএস যোদ্ধার স্ত্রী শামীমা বেগম।

শামীমার দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে দাবি করে ইতোমধ্যে লন্ডনে ফিরতে আগ্রহী শামীমার নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছেন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভেদ। প্রকৃতপক্ষে দ্বৈত নাগরিকত্ব না থাকার ফলে আজ শামীমা হয়ে গেছেন এক রাষ্ট্রহীন নাগরিক। নিয়মানুযায়ী নাগরিকত্ব বাতিলের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২৮ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে শামীমাকে।

কিন্তু অনেকেই শামীমার এই নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলেন লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন। নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার এই বিষয়টিকে ‘চরম পন্থা’ বলেও অভিহিত করেছেন তিনি। মি. করবিনের সঙ্গে একই মন্তব্য করেছেন ব্রিটেনের শ্যাডো হোম সেক্রেটারি ডায়ান অ্যাবোট।

শামীমার পরিবার বাংলাদেশ থেকে এসেছে এই যুক্তিতে তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক দাবি করে আইনজীবী তাসনিম আখুনজি বলেছেন, “এটা বেআইনি। নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হলে সে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বে। আর সেটা হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন”।

ব্রিটিশ নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করা নিজের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব উল্লেখ করে সাজিদ জাভেদ বলেন, এ পর্যন্ত নয়শ’র বেশি ব্রিটিশ নাগরিক যুক্তরাজ্য ছেড়ে আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া ও ইরাকে গেছে। তাদের ব্রিটেনে ফেরা ঠেকাতে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে তিনি সংকোচবোধ করবেন না।

এদিকে ব্রিটিশ সরকারের এমন সিদ্ধান্তে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে থাকা এসব নাগরিকরা। কারণ ব্রিটিশ সরকার নাগরিকত্ব বাতিল করে দিলে তারা আর ব্রিটেনে ফিরতে পারবেন না। আর দ্বৈত নাগরিকত্ব না থাকায় অন্য কোনো দেশেও তাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। ফলে তারা হয়ে পড়বে রাষ্ট্রহীন। আর তা হলে তাদের ভবিষ্যৎ কী?

সিরিয়া ও ইরাক থেকে যুদ্ধ ফেরত আইএস যোদ্ধাদের ফেরত নিতে ইউরোপের দেশগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার মতে আইএস যোদ্ধারা যে দেশ থেকে সেখানে যুদ্ধ করতে গেছে, সেই দেশগুলোকে তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু জার্মানিসহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশগুলো ট্রাম্পের সঙ্গে একমত নয়।

আর যদি দেশগুলো তাদের নাগরিকদের ফেরত না নেয় এবং নাগরিকত্ব বাতিল করে, তবে তারা রাষ্ট্রহীন বলে স্বীকৃত হবে এবং তাদের মর্যাদা হবে শরণার্থী।

কারণ রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের মর্যাদা সংক্রান্ত ১৯৫৪ সালের কনভেনশনে বলা আছে, যেসব ব্যক্তির নাগরিকত্ব বা জাতীয়তা কোনো দেশের আইন দ্বারা স্বীকৃত হয় না, তাদেরকে বলা হবে রাষ্ট্রহীন। ১৯৬১ সালে আরেকটি কনভেনশন প্রণীত হয়েছে যেখানে রাষ্ট্রহীন নাগরিকদের সুরক্ষায় বিভিন্ন নীতিমালা ও কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে।

আর এ দুটি নীতিমালার আলোকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশন (ইউএনএইচসিআর) রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের সুরক্ষায় বেশ কিছু নীতিমালা ও কার্যক্রম গ্রহণ করেছে এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে রাষ্ট্রহীন নাগরিকদের মৌল মানবিক অধিকার নিশ্চিত করতে সাহায্য করে আসছে।

সুতরাং বলা যায় যে, নাগরিকত্ব বাতিল হওয়ায় যারা রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বে তাদের মর্যাদা হবে একজন শরণার্থী। আর শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত দেশের আইন ও নীতিমালার উপরই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।

ইন্টারনেট অবলম্বনে লিখেছেন এনামুল হক।

 

টাইমস/ইএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সত্য উন্মোচন হওয়ায় বিএনপির মাথা খারাপ হয়ে গেছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী Mar 29, 2024
img
জিম্মি জাহাজের নাবিকদের জন্য ছাগল-দুম্বা আনছে জলদস্যুরা Mar 29, 2024
img
ঈদে বাড়তি ভাড়া নিলে ৯৯৯-এর সহায়তা নিন: আইজিপি Mar 29, 2024
img
ওপারের গোলাগুলি-বিস্ফোরণের শব্দে কাঁপছে সেন্ট মার্টিন Mar 29, 2024
img
জুনের মধ্যেই ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী Mar 29, 2024
img
বাজারে বেড়েছে মাংসের দাম, সবজিতে স্বস্তি Mar 29, 2024
img
বিএনপির ৮০ ভাগ নিগৃহীত নেতাদের তালিকা দিতে হবে : ওবায়দুল কাদের Mar 29, 2024
img
জায়েদ খানের নায়িকা হচ্ছেন টালিউডের পূজা ব্যানার্জি Mar 29, 2024
img
বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর পৌনে ৪ কিলোমিটার দৃশ্যমান Mar 29, 2024
img
আজ ঢাকার বাতাস ‘অস্বাস্থ্যকর’ Mar 29, 2024