সত্যজিৎ রায়: অস্কারজয়ী প্রথম বাঙালি

সত্যজিৎ রায়, একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি চলচ্চিত্রকার। তিনি একাধারে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক ও সঙ্গীত পরিচালক। যে কয়জন ব্যক্তির হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্র বিশ্ব দরবারে পরিচিত পেয়েছে, তিনি তাদের একজন। কেবল বাঙালি হিসেবেই নয়, তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারদের একজন।

তিনিই প্রথম বাঙালি, যিনি ১৯৯২ সালে সম্মানসূচক অস্কার পুরস্কার পেয়েছিলেন। আর চ্যাপলিনের পর তিনিই দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, যাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।

১৯২১ সালের ২মে, কলকাতার এক শিল্প ও সাহিত্য সমাজের বাঙ্গালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার মসূয়া গ্রামের অধিবাসী। তার দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায় ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার একজন বিখ্যাত লেখক, চিত্রকর ও দার্শনিক। উপেন্দ্রকিশোরের ছেলে সুকুমার রায় ছিলেন সত্যজিতের বাবা, যিনি ছিলেন বাংলা শিশু সাহিত্যের এক কিংবদন্তী শিল্পী।

মাত্র তিন বছর বয়সেই বাবা সুকুমার মারা যান। মা সুপ্রভা দেবী বহু কষ্টে তাকে লালনপালন করেছেন। চারুকলার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকলেও তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়েছেন। এরপর মায়ের উৎসাহ-উদ্দীপনায় রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। এখানে থাকার সময়ই ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতির ওপর সত্যজিতের গভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ জন্মায়।

১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং মাত্র ৮০ টাকা বেতনে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় ‘ভিজুয়ালাইজার’ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে কাজ করার সময় তিনি অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার সুযোগ পান। এসময় বিভূতিভূষণের বিখ্যাত উপন্যাস পথের পাঁচালীর একটি শিশু সংস্করণ নিয়ে কাজ করেন। এটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি খুবই অনুপ্রাণিত হন, যা পরে তিনি তার প্রথম চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন।

১৯৪৭ সালে তিনি ‘কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করতে ভূমিকা রাখেন। সোসাইটির সদস্য হিসেবে বিভিন্ন বিদেশী চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ হয়, যা তাকে চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করে।

১৯৪৯ সালে তিনি বান্ধবী বিজয়া দাসকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরেই আরেক গুণী ব্যক্তিত্ব সন্দ্বীপ রায়ের জন্ম হয়, যিনি নিজেও একজন প্রথিতযশা চলচ্চিত্র পরিচালক।

ওই বছরই বিখ্যাত ফরাসি পরিচালক জঁ রনোয়ার তার ‘দ্য রিভার’ চলচ্চিত্রের কাজ করতে কলকাতায় আসেন। তাকে গ্রামে চিত্রস্থান খুঁজতে সহযোগিতা করেন সত্যজিৎ। রনোয়ারের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তিনি পথের পাঁচালী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এ কাজে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে সত্যজিতকে চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ দেন রনোয়ার।

১৯৫০ সালে বিজ্ঞাপন সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে কাজ করতে তাকে লন্ডনে পাঠানো হয়। লন্ডনে থাকাকালে প্রায় ৯৯টি চলচ্চিত্র দেখেন। এর মধ্যে অন্যতম একটি ছিল ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী চলচ্চিত্র ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’ (‘সাইকেল চোর)। এই চলচ্চিত্রটি সত্যজিতকে এতই প্রভাবিত করেছিল যে, হল থেকে বের হবার পর তিনি পাকা সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি একজন চলচ্চিত্রকার হবেন।

সেই থেকে তিনি ‘পথের পাঁচালী’ দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করে দেন। কিন্তু প্রথম দিকে কেউ তার চলচ্চিত্রে অর্থায়ন করার সাহস পাচ্ছিল না। কারণ একে তো পরিচালক হিসেবে সত্যজিৎ একেবারে নতুন, অন্যদিকে চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু অনেক সনাতন ধারার। অবশেষে ১৯৫২ সালে তিনি এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন এবং প্রায় আড়াই বছর পর ১৯৫৫ সালে তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পায়। এর সংগীত পরিচালনা করেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী পণ্ডিত রবি শংকর।

তার এই চলচ্চিত্রটি কেবল জনপ্রিয়ই হয়নি, সমালোচকদের কাছে এটি ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এটি ১৯৫৬ সালের কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হবার পাশাপাশি প্রায় ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়। এরপর তিনি পথের পাঁচালির সিকোয়েন্স হিসেবে অপরাজিত (১৯৫৬) ও অপুর সংসার (১৯৫৯) চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এ তিনটি তার ত্রয়ী চলচ্চিত্র হিসেবে বিখ্যাত হয়। অপরাজিত চলচ্চিত্রটি ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার জেতে। এভাবে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক মহলে সত্যজিতের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

এরপর একে একে তিনি পরশ পাথর, জলসাঘর, চারুলতা, দেবী, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মহানগর, তিন কন্যা, অভিযান, নষ্টনীড়, ঘরে বাইরে, অভিযান, নায়ক, জানা অরণ্য, কাপুরুষ, মহাপুরুষ, গোপী গাইন বাঘা বাইন, জয় বাবা ফেলুনাথ ইত্যাদি অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। যার অধিকাংশই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।

তার চলচ্চিত্রে চিরায়ত বাংলার নিসর্গ প্রকৃতি, সংস্কৃতি, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব এবং সমস্যা, আবেগ, অনুভূতি, ইত্যাদি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। সমালোচকদের মতে তার মত করে চলচ্চিত্রের পর্দায় ভারতীয় নারীদের এত অনুভূতি দিয়ে এর আগে কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। তাইতো সমালোচক পলিন কেল মন্তব্য করেছিলেন যে, সত্যজিৎ নারী নয়, একজন পুরুষ; একথা তিনি বিশ্বাস করতে পারেন নি। ইরানের কিংবদন্তী চলচ্চিত্র পরিচালক মাজিদ মাজিদি সত্যজিতের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

চলচ্চিত্রে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃত স্বরূপ ভারত সরকার কর্তৃক ৩২টি ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। ১৯৭৯ সালে ১১তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি পুরস্কৃত হন। বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে তিনি রেকর্ড সাতবার মনোনয়ন পান। ১৯৮২ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন লায়ন অনারারি অ্যাওয়ার্ড, ১৯৮২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে অনারারি অ্যাওয়ার্ড, ১৯৮৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড এবং ১৯৮৭ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ‘লিজন অব অনার’ সম্মাননায় ভূষিত হন সত্যজিৎ।

১৯৬৫ সালে তাকে ‘পদ্মভূষণ’ এবং ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারত রত্ন’ পদকে ভূষিত করে ভারত সরকার।

২০০৪ সালে বিবিসির শ্রোতাজরিপে নির্বাচিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালির তালিকায় তার স্থান ছিল ১৩ তম।

১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র কেবল একজন কিংবদন্তী ব্যক্তিত্বকেই হারায়নি, সমাপ্তি ঘটে এক বর্ণিল ইতিহাসের। বাংলা চলচ্চিত্রে যার শূন্যতা আজও পূরণ হয়নি। 

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on: