পুরো দেশ যখন করোনা নামক এক মহামারীর থাবায় বিপর্যস্ত, তখন গত ১১ জুন ২০২০ তারিখে মহান জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপিত হয়। যেটি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ তম বাজেট ছিলো। বহুল প্রতীক্ষিত এই বাজেট কেমন ছিলো, বা জনগণের আশার কতখানি বা পূরণ করতে পারলো এই বাজেট তা নিয়েই শাবিপ্রবি অর্থনীতি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন গত ২৭ জুন 'করোনা কালের বাজেট ও জনপ্রত্যাশা' শীর্ষক একটি ওয়েবিনার আয়োজন করে।
ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন - ফেডারেল গভর্নমেন্ট অব কানাডার অর্থনীতিবিদ ড. নাসিম সাইদী, বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ড. মুস্তাফিজ মুনির, কালের কণ্ঠের সিনিয়র সাংবাদিক ফারুক মেহেদী, সুইডেনের লিংকোপিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. গাজী সালাহ উদ্দিন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুনতাহা রাকিব। ওয়েবমিনারটি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন শাবিপ্রবি অর্থনীতি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাসমির রেজা।
উক্ত ওয়েবিনারে বিভিন্ন সেক্টর ভিত্তিক বরাদ্দ এবং করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা হয়। উক্ত আলোচনার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-
ওয়েবিনারের প্রথমে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ২০২০-২১ সালের বাজেট সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন পেশ করা হয়। সেই প্রতিবেদনে বাজেটের আকার (৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা), জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা (৮.২%), মূল্যস্ফীতি (৫.৪%) এবং এতো বড় বাজেটের অর্থের যোগান কীভাবে হবে সেই সম্পর্কে বলা হয়। এছাড়াও বাজেট পরবর্তী সময়ে কোন কোন দ্রব্যের দাম বাড়বে এবং কোন কোন দ্রব্যের দাম কমবে সেই সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
পরবর্তী সময়ে উপস্থিত সকল প্যানেলিস্টদের থেকে বাজেট নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন তাদের বাজেট নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তখন বাংলাদেশের নির্ধারিত সময়ে বাজেট পেশ করাকে ড. নাসিম সাইদী একটি সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখেন। তিনি আরও বলেন, 'বাজেটের বাস্তবায়ন এবং প্রভাব করোনা মহামারীর স্থায়িত্বের উপর অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করছে। এছাড়াও আমাদের অর্থনীতি কীভাবে রিকভারি করছে তার উপরও বাজেটের বাস্তবায়ন নির্ভর করছে।'
সাংবাদিক ফারুক মেহেদী এই বাজেটকে গতানুগতিক বাজেট হিসেবেই দেখছেন। তিনি বলেন, 'বাজেটের আকারের পরিবর্তন হলেও অন্য বছরগুলোর মতোই গঠন কাঠামো রয়ে গেছে।' এ মহামারী অতিক্রম করার জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব তিনি দেখছেন।
আই এম এফ(IMF) এর তথ্যমতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সামনের এক বছরে প্রায় ২.৮% জিডিপি কমে যাবে এবং আইএলও (ILo) এর তথ্যমতে পুরো পৃথিবীতে প্রায় ২০% প্রবাসী আয় কমে যাবে। এমন এক বাস্তবতায় সামনের বাজেটে যে জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা (৮.২%) ধরা হয়েছে তা পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন ড.মুনতাহা রাকিব।
তিনি পুরো বিষয়টিকে করোনা কালীন এবং করোনা পরবর্তী সময়- এই ২টি ভাগে বিভক্ত করতে চান। তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমাদের গুরুত্ব না দিয়ে স্বাস্থ্যখাতকে প্রাধান্য দেয়া উচিত'।
ড. মুস্তাফিজ মুনির ব্যাংকিং খাত নিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং করোনা মহামারীর কারণে ব্যাংকিং সেক্টর তারল্য সংকট দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ তৈরী করবে বলে তিনি মনে করেন।
অন্যান্য দেশের অর্থনীতি যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে তখন ড. গাজী সালাউদ্দীন আমাদের অর্থনীতির অবস্থা তুলনামূলক ভালো বলে মত প্রকাশ করেন। খাদ্য-নিরাপত্তা, প্রবাসী আয় অর্থনীতিতে কৃষির তুলনামূলক বেশি অবদান আমাদেরকে এই নিরাপত্তা দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এ ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে করোনা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা নতুন নীতি নির্ধারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন।
২০২০-২১ বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহের যে পরিমাণ ধরা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয় বলে মত প্রকাশ করেন- ফারুক মেহেদী। দেশে সামগ্রিক উন্নয়নের সাথে সাথে (বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি, প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ বৃদ্ধি) ইত্যাদির সাথে রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ যে হারে বেড়েছে সেটি আশাব্যঞ্জক নয় বলে মনে করেন তিনি।
ড. নাসিম সাইদী বলেন, বিশ্বের যে সকল দেশের সাথে আমাদের বাণিজ্যের সম্পর্ক রয়েছে তাদের অর্থনীতির ব্যবস্থার উপর আমাদের রিকভারি এবং সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করছে'। ভৌগোলিক মন্দার কারণে আমাদের দেশের করপোরেট করের পরিমাণ কমে যেতে পারে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন। অর্থনীতিকে পূর্বের অবস্থায় তাড়াতাড়ি ফিরানোর ক্ষেত্রে তিনি দেশের ভঙ্গুর ট্যাক্স ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর বিকল্প দেখছেন না।
স্বাস্থ্যখাতে যদিও এবার ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ১৩.৭ গুণ (প্রায় ২৯,২৪৭ কোটি টাকা) বরাদ্দ দেয়া হয়, কিন্তু এটি আমাদের মতো দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামোর দেশে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন ড. মুনতাহা রাকিব।
তিনি বলেন, 'যে দেশে ১০০০ জন মানুষের জন্য মাত্র ৬ জন ডাক্তার এবং ৪ জন নার্স রয়েছেন সে দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বরাদ্দকে ব্যয় হিসেবে না দেখে বিনিয়োগ হিসেবে দেখা উচিত।' তিনি স্বাস্থ্যখাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণেও গুরুত্বারোপ করেন।
ড. মুস্তাফিজ মুনির ব্যাংক ব্যবস্থায় পুনঃকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেন। করোনা পরিস্থিতিতে যাতে নিম্নমধ্যবিত্ত বা তরুণ উদ্যোক্তাদের উপর চাপ তৈরি না হয় সে জন্য ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে তাদের লোন দেয়া নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থায় নতুন নীতি প্রণয়নের বিকল্প দেখছেন না তিনি।
ড. সালাউদ্দিন বৈদেশিক আয়ের উপর গুরুত্বারোপ করেন। করোনা পরবর্তী সময়ে আমরা যে 'নিউ নরমাল' অবস্থার মধ্যে পড়তে যাচ্ছি সেই অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার উপর কী ধরনের চাপ তৈরি হতে পারে সেটি সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করেন তিনি। এই ক্ষেত্রে তিনি এ চাপ উত্তরণে 'zero Tolerance' নীতির বিকল্প দেখছেন না।
করোনা পরবর্তী সময়ে থেকে সরকার প্রায় ১ ট্রিলিয়ন টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ (জিডিপির ৩.৬%) ঘোষণা করেছে। আর্থিক প্রণোদনার প্যাকেজের যাতে সঠিক বণ্টন হয় সে ক্ষেত্রে প্যানেলিস্টরা একমত পোষণ করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্ষেত্র কিন্তু এই বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট যে পরিকল্পনা দরকার তা লক্ষ্য করা যায় নি। দেশের আর এম জি (RMG) সেক্টর যখন সংকটের সম্মুখীন তখন অন্য সেক্টরে বিনিয়োগ করার বা ঢেলে সাজানোর এটাই সময় ছিলো। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়নি বলে প্যানেলিস্টরা মনে করেন।
পরিশেষে করোনা মোকাবেলায় যে বাজেট এবং প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন চান প্যানেলিস্টরা। আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন যাতে হয় সে ক্ষেত্রেও তারা গুরুত্বারোপ করেন।
লেখা: সাইয়িদ আরাফাত জুবায়ের, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, শাবিপ্রবি।