ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ ও প্রতিরোধে করণীয়

বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব অনেক আগে থেকেই। প্রায় প্রতি বর্ষাতেই কমবেশি লোকের ডেঙ্গুজ্বর হয়ে থাকে। এবছর দেশে ডেঙ্গুজ্বর বলতে গেলে মহামারি আকার ধারণ করেছে। রাজধানী ঢাকা ছাড়িয়ে ডেঙ্গু এখন দেশের বিভিন্ন এলাকাতে ছড়িয়ে পড়ছে।

চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ সারা দেশে সম্প্রতি ডেঙ্গুতে অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যদিও সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা আটজন বলা হচ্ছে। এছাড়া প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রচুর মানুষ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। সরকারি হাসপাতাল গুলোর ওয়ার্ডের বিছানা, মেঝে ও বারান্দায় রোগীদের জায়গা হচ্ছে না।

অনেকে রাজধানী থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরছেন। এ কারণে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে মানুষের মাঝে প্রবল উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

শরীরে কোন লক্ষণ দেখলে আপনি বুঝবেন যে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এবং এমন পরিস্থিতিতে আপনার করণীয় কী হতে পারে? এ নিয়ে চিকিৎসকরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন।

১. ডেঙ্গুর জ্বরের সময়কাল

সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ থাকে। কারণ এ সময়টিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরের সময়কাল আরও এগিয়ে এসেছে। এখন জুন মাস থেকেই ডেঙ্গুজ্বরের সময় শুরু হয়ে যাচ্ছে।

২. ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো কী?

সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেবার পর আবারও জ্বর আসতে পারে। এর সঙ্গে শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ (র‍্যাশ) হতে পারে। তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে।

৩. জ্বর হলে কী করণীয় ?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ বলছেন, এখন যেহেতু ডেঙ্গুর সময়, সেজন্য জ্বর হল অবহেলা করা উচিত নয়। জ্বরে আক্রান্ত হলেই সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ।

তিনি বলছেন, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তারা জ্বরকে অবহেলা করেছেন।

৪. কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন ?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গুজ্বরের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এই জ্বর সাধারণত নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়াই ভালো। যেমন-

  • শরীরের যেকোনো অংশে রক্তপাত হলে।
  • প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে।
  • শ্বাসকষ্ট হলে বা পেট ফুলে পানি এলে।
  • প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে।
  • জন্ডিস দেখা দিলে।
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে।
  • প্রচণ্ড পেটে ব্যথা বা বমি হলে।

৫. বিশ্রামে থাকতে হবে

সরকারের কমিউনিক্যাবল ডিজিজ কন্ট্রোল বা সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ বিভাগের অন্যতম পরিচালক ড. সানিয়া তাহমিনা বলেন, জ্বর হলে বিশ্রামে থাকতে হবে। তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, জ্বর নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা উচিত নয়। একজন ব্যক্তি সাধারণত প্রতিদিন যেসব পরিশ্রমের কাজ করে, সেগুলো না করাই ভালো।

৬. কী খাবেন ?

প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন - ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস এবং খাবার স্যালাইন গ্রহণ করা যেতে পারে। এমন নয় যে প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে, পানি জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।

অধ্যাপক তাহমিনা বলেন, ''ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ চারটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে।''

৭. যেসব ঔষধ খাওয়া উচিত নয়

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে বলে জানান অধ্যাপক তাহমিনা।

৮. ডেঙ্গুজ্বরের ক্যাটাগরি

ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ভাগ রয়েছে। এ ভাগগুলো হচ্ছে - 'এ', 'বি' এবং 'সি'। প্রথম ক্যাটাগরির রোগীরা নরমাল থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী 'এ' ক্যাটাগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হবার কোন প্রয়োজন নেই।

'বি' ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীদের সবই স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন তার পেটে ব্যথা হতে পারে, বমি হতে পারে প্রচুর কিংবা সে কিছুই খেতে পারছে না। অনেক সময় দেখা যায়, দুইদিন জ্বরের পরে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হাসপাতাল ভর্তি হওয়াই ভালো।

'সি' ক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বর সবচেয়ে খারাপ। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ'র প্রয়োজন হতে পারে।

৯. এডিস মশা কখন কামড়ায়

ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা অন্ধকারে কামড়ায় না। সাধারণত সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে উঠে। এডিস মশা কখনো অন্ধকারে কামড়ায় না।

১০. পানি জমিয়ে না রাখা

অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলছেন, ''এডিস মশা 'ভদ্র মশা' হিসেবে পরিচিত। এরা জমানো স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এরা ডিম পাড়ে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে মশা নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কোথাও যাতে পানি তিন থেকে পাঁচদিনের বেশি জমা না থাকে।

বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোলা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে।

সর্বোপরি, ডেঙ্গুজ্বরের মশা এ দেশে আগেও ছিল, এখনো আছে, মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। তাই একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে বাঁচা সম্ভব।

 

টাইমস/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সারাদেশে ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট জারি Apr 19, 2024
img
বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীদের তালিকায় আলিয়া Apr 19, 2024
img
পালিয়ে আসা ২৮৫ জনকে ফেরত নিচ্ছে মিয়ানমার: পররাষ্ট্রমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
গ্রেপ্তারি পরোয়ানার শঙ্কায় নেতানিয়াহু, ইসরায়েলে জরুরি বৈঠক Apr 19, 2024
img
পালিয়ে বাংলাদেশে এলেন আরও ১১ বিজিপি সদস্য Apr 19, 2024
img
কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন শেখ হাসিনা Apr 19, 2024
img
প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন : অর্থমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে গেল বাস, প্রাণ গেল প্রকৌশলীর Apr 19, 2024
img
চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি Apr 19, 2024
img
৩টি ড্রোন ধ্বংস করল ইরান, ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনা নিরাপদ Apr 19, 2024