লরিতে ব্রিটেনে আসা জাওয়াদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা

ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের মধ্যাঞ্চল থেকে ২০ মাইল দূরে এসেক্সের গ্রেস শহরের শিল্প এলাকায় একটি লরির কনটেইনারের ভেতর ঠান্ডায় জমে গিয়ে মারা যাওয়া ৩৯ জন চীনার মরদেহ উদ্ধার করছে পুলিশ। তাদের করুণ মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে ব্রিটেনে। উদ্ধার হওয়ার লাশগুলোর ৮ টি নারীর আর ৩১ টি পুরুষের। যে কনটেইনারে লুকিয়ে এরা ব্রিটেনে আসার চেষ্টা করেছিলেন, সেটিতে সাধারণত হিমায়িত অবস্থায় খাদ্য পরিবহন করা হয়।

বেলজিয়াম থেকে লরিটি ব্রিটেনে প্রবেশ করেছিল। আয়ারল্যান্ডের অন্যতম সমুদ্রবন্দর হোলিহেড দিয়ে  মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেলজিয়ামের জিব্রেগা থেকে এসেক্সের পারফ্লিটে আসে লরিটি।

এই কাজ করতে গিয়ে আগেও বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে ট্রাক বা কনটেইনারের ভেতর। ঠান্ডায় জমে বা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে তাদের অনেকে।

আফগানিস্তানের বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক জাওয়াদ আমিরি। তিনিও কয়েক বছর আগে কনটেইনারে করে লন্ডনে এসেছিলেন। সেই যাত্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রায় মারাই যাচ্ছিলেন। ৩৯ চীনা নাগরিকের মৃত্যু তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে নিজের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।

জাওয়াদ আমিরির ভাষায়, তারা যেন একটি 'চলন্ত কবরের' মধ্যে ছিলেন।

২৮ বছর বয়সী জাওয়াদ আমিরি ফ্রান্সের উপকূলে ক্যালে বন্দর থেকে একটি কনটেইনারের ভেতর লুকিয়ে তিনি ব্রিটেন ঢোকেন। তারা ছিলেন মোট ১৫ জন অভিবাসীর একটি দল।

কনটেইনারটি ছিল সিলগালা করা। ব্রিটেনের এম-ওয়ান মোটরওয়ে দিয়ে যখন এই কনটেইনারটি নিয়ে লরিটি যাচ্ছিল, তখন ভেতরে অক্সিজেনের স্বল্পতায় সবাই মরতে বসেছিলেন।

জাওয়াদের ৭ বছর বয়সী এক ভাইয়ের ক্ষুদে বার্তা তাদের সবার জীবন বাঁচায়। বিবিসির কাছে জাওয়াদ বর্ণনা করেছেন সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।

এটি ছিল এক চলন্ত কবর

জাওয়াদ আমিরি বলেন, ‘প্রতি রাতে মানুষ পাচারকারী দলের লোকজন একটি লরি নিয়ে আসতো। সেটির পেছনে তারা ২০ হতে ৩০ জন পর্যন্ত অভিবাসীকে তুলতো। প্রত্যেকের কাছ থেকে তারা টাকা নিত। আপনি বাঁচলেন না মরলেন, সেটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।’

‘আমি এবং আমার সাত বছরের ছোট ভাই আহমদ একটি রেফ্রিজারেটেড লরির পেছনে উঠি। আমাদের সঙ্গে আরও ১৩ জন। আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে ওরা লরির দরজা বন্ধ করে দিল। সবাই তখন ভীষণ ভয়ে আর আতঙ্কে। কারণ ভেতর থেকে দরজা খোলার কোনো উপায় ছিল না।’

‘লরির ভেতরে ছিল অনেক ওষুধের বাক্স। দুই সারি ওষুধের বাক্সের মাঝখানে একটুখানি জায়গা, বড়জোর আধা মিটার(দেড় ফুটের একটু বেশি)। সেখানে আমাদের প্রায় ১৫ থেকে ১৬ ঘন্টা ধরে শুয়ে থাকতে হয়েছিল। আমাদের নড়াচড়ার কোনো জায়গা ছিল না। বসার উপায় নেই, দাঁড়ানোর উপায় নেই। মনে হচ্ছিল আমরা যেন একটা চলন্ত কবরের মধ্যে শুয়ে আছি।’

‘ভেতরে ছিল পুরোপুরি অন্ধকার। শুরুতে বেশ ঠান্ডা ছিল। কারণ এটি রেফ্রিজারেটেড কনটেইনার। কিন্তু এরপর এয়ারকন্ডিশনিং আর কাজ করছিল না, এটি বিকল হয়ে গিয়েছিল। এরপর ভেতরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলো।’

‘আমরা আমাদের কম্বল সরিয়ে নিলাম, কাপড়-চোপড় খুলে ফেললাম। আমাদের সাথে কেবল অল্প পানি ছিল। তারপর পানিও ফুরিয়ে গেল। আমাদের টয়লেটে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই।’

জাওয়াদের ছোট ভাই আহমদ

আমরা দেয়ালে জোরে জোরে আঘাত করছিলাম

‘ভেতরে শ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমার ভাই কাঁদছিল। ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল আর কাশছিল। আমি ওকে বলে যাচ্ছিলাম, সব ঠিক হয়ে যাবে, ওরা দরজা খুলে দেবে। আমরা ঘামছিলাম। কনটেইনারের ভেতরটা আরও গরম হয়ে উঠছিল। আমরা কথা পর্যন্ত বলতে পারছিলাম না। আমরা চিৎকার করে ড্রাইভারকে ডাকছিলাম, দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলাম।’

‘ড্রাইভার অনেক বার থেমেছিল। আমরা আশা করছিলাম যে ও দরজা খুলবে। কিন্তু ও দরজা খুলতে চায়নি। খুব খারাপ ভাষায় ও আমাদের গালাগালি দিচ্ছিল এবং আমাদের চুপ থাকতে বলছিল চিৎকার করে। আমাদের মধ্যে কারও কারও কাছে ফোন ছিল। কিন্তু ওরা পুলিশ ডাকতে চাইছিল না।’

‘কারণ ওদের ভয় ছিল, পুলিশ ডাকলে সবাই তো ধরা পড়ে যাবে, তারপর সবাইকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেবে।’

ভেতরে কোনো অক্সিজেন ছিল না

‘আমার ফোনের ব্যাটারি প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার ভাই আহমদের ফোনটা ছিল খুব ছোট। আহমদ ওর ফোন থেকে আমাদের অভিবাসী ক্যাম্পের একটি এনজিও'র এক নারীকে ক্ষুদে বার্তা পাঠালো। আহমদকে ওই নারীই ফোনটি দিয়েছিল।’

‘আহমদ লিখেছিল, আমাদের সাহায্য কর। লরির ভেতরে কোনো অক্সিজেন নেই এবং ড্রাইভার থামছে না। ওই নারী তখন জবাব দিল, তোমরা নড়াচড়া করো না। বেশি কথাও বলো না। আমরা পুলিশ ডাকছি।’

‘এরপর পুলিশ আসলো। তাদের সঙ্গে ছিল কুকুর। পুলিশ এসে লরিটি খুঁজে বের করলো। তারপর পেছনের দরজা খুলে দিল। এরপর আমরা সবাই খুশি। কেউ কেউ অবশ্য ভয় পাচ্ছিল এই ভেবে যে এখন আমাদের তো ফেরত পাঠিয়ে দেবে।’

‘একজন ডাক্তার এসে আমাদের সবাইকে পরীক্ষা করলো। ডাক্তার বললো আমরা সবাই ঠিক আছি। তারপর আমাদেরকে একটি হোস্টেলে নিয়ে যাওয়া হলো।’

ওদের জন্য আমার খুব দুঃখ লাগছে

‘আমি এখন সুখী। আমার যুক্তরাজ্যে থাকার অনুমতি আছে। আমি এখন একটি কলেজে কোর্স করছি নির্মাণ শিল্পে কাজ করার জন্য। আমার ছোট ভাইয়ের বয়স এখন ১০ বছর। লরিতে আমাদের যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটি নিয়ে এবং ওর স্বপ্ন নিয়ে সে একটা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রোগ্রাম তৈরি করেছে।’

‘আমি গাড়িতে যাওয়ার সময় আমার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন তার কাছ থেকে অ্যাসেক্সে এই অভিবাসীদের মৃত্যুর খবর পাই। সাথে সাথে আমার মনে হচ্ছিল, আমার শরীর হয়তো আমার গাড়িতে, কিন্তু মানসিকভাবে আমি যেন ফিরে গিয়েছিলাম সেই লরির ভেতরে। আমি অসুস্থ বোধ করছিলাম। আমার সেই দুঃসহ স্মৃতি যেন ফিরে আসছিল। আমার মনে হয় ওরা অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছে। ওদের জন্য আমার এত খারাপ লাগছে।’

‘ওরা তো কেবল ৩৯ জন মানুষ মাত্র নয়। ওদের আছে ৩৯টি পরিবার। যারা হয়তো হারিয়েছে একজন ভাই বা একজন বোনকে। ব্রিটেনের মানুষ খুব বুদ্ধিমান, ভালো এবং দয়ালু। যারা নিজের বাড়ি-ঘর, পরিবার এবং সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে এভাবে ভিনদেশে পাড়ি জমায় - তাদের ব্যাপারে এ্ই ঘটনার পর আমরা যেন আরও দায়িত্বশীল হই, সেটাই আমি আশা করব।’

 

টাইমস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সারাদেশে ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট জারি Apr 19, 2024
img
বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীদের তালিকায় আলিয়া Apr 19, 2024
img
পালিয়ে আসা ২৮৫ জনকে ফেরত নিচ্ছে মিয়ানমার: পররাষ্ট্রমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
গ্রেপ্তারি পরোয়ানার শঙ্কায় নেতানিয়াহু, ইসরায়েলে জরুরি বৈঠক Apr 19, 2024
img
পালিয়ে বাংলাদেশে এলেন আরও ১১ বিজিপি সদস্য Apr 19, 2024
img
কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন শেখ হাসিনা Apr 19, 2024
img
প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন : অর্থমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে গেল বাস, প্রাণ গেল প্রকৌশলীর Apr 19, 2024
img
চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি Apr 19, 2024
img
৩টি ড্রোন ধ্বংস করল ইরান, ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনা নিরাপদ Apr 19, 2024