২১ বছর পর মায়ের কাছ ফিরল মেয়ে

ঠিক ২০ বছর ১০ মাস দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। ‘এখনও ফিরে এল না সে।’ নিজের ঘরে বসে দিনরাত একই কথা ভাবেন মা।

বাদামি চুলের হাসিখুশি কিশোরী মেয়ের ঘরে ফেরার আশায় সময় কাটে সিন্থিয়া হাগের। ভাবেন, একদিন না একদিন ঠিক ফিরে আসবে তার মেয়ে ক্রিস্টাল। প্রায় ২১ বছর আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন তিনি। তারপর একদিন হঠাৎই ফিরলেন ক্রিস্টাল। ‘কেন ফিরে এল? নিখোঁজই বা হয়েছিল কেন? এত দিন কোথায় ছিল?’ একরাশ প্রশ্ন ঘোরাফেরা করতে থাকে সিন্থিয়ার মনে।

আমেরিকার বাল্টিমোরের সারিবাঁধা ঘরের বাইরে প্রায় একুশ বছর পা রাখেননি সিন্থিয়া। যদি তার ক্রিস্টাল ফিরে আসে। সেই অপেক্ষায় বসে থাকেন তিনি।

গত বছরের মার্চে হঠাৎই সিন্থিয়ার ফোন বেজে উঠল। ফোনের অন্য প্রান্তে তার আরেক মেয়ে বিয়াঙ্কা ডেভিস। মাকে জানাল, ফেসবুকে একটা মেসেজ পেয়েছে সে। আর সেটা পাঠিয়েছে ক্রিস্টাল।

ক্রিস্টালের খোঁজ মিলতেই তড়িঘড়ি গাড়ি নিয়ে তার বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলেন বিয়াঙ্কা। উত্তর হার্লেমে থাকেন ক্রিস্টাল। সেখান থেকে তাকে বাল্টিমোরের বাড়িতে নিয়ে আসেন বিয়াঙ্কা।

বহু বছর পর আবার মেয়ের সামনাসামনি সিন্থিয়া। তার সেই ছোট্ট মেয়েটির চুল এখন ছোট করে ছাঁটা। কীভাবে যেন স্প্যানিশ ভাষাটা রপ্ত করেছে। তবে সে আর ক্রিস্টাল হাগ নন। ক্রিস্টাল স্যান্ডার্স। বয়স হওয়ার কথা ছিল পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। তবে নিজের বয়স জানাচ্ছেন ৪৪। তা সে যা-ই হোক না কেন, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে মেতে উঠলেন সিন্থিয়া। ক্রিস্টালের ফিরে আসার খবর জানতে পেরে আনন্দে মেতে উঠেছিলেন পশ্চিম বাল্টিমোরে সিন্থিয়ার পড়শিরাও।

সিন্থিয়ার মনে পড়ে যায় সেই দিনটার কথা, যে দিন তার মেয়েকে শেষ বারের মতো দেখেছিলেন। সে দিনটা ছিল শনিবার। ২৬ এপ্রিল, ১৯৯৭। স্থানীয় একটি গ্রোসারি শপে ক্যাশিয়ারের কাজ করতেন সিন্থিয়া। সে দিন কাজে যাওয়ার আগে মেয়েকে বলেছিলেন, ‘বাড়ির আশপাশেই থেকো।’ এরপর কাজ থেকে ফিরে আর মেয়েকে খুঁজে পাননি তিনি।

‘ক্রিস্টালকে কি কেউ অপহরণ করল? সে কি পালিয়ে গেল?’ আশঙ্কাগুলো মনে এলেও তা মানতে চাননি প্রথমটায়। পরে ভেবেছেন, হয়তো তার মেয়েকে মেরে ফেলেছে কেউ বা সে মরেই গিয়েছে। তা-ও কোনোভাবে ক্রিস্টালের ফেরার আশা ছাড়েননি সিন্থিয়া। বহু বার রাস্তাঘাটে মেয়েকে খুঁজেছেন। কিন্তু তার খোঁজ মেলেনি। পুলিশের খাতাতেও ক্রিস্টালের তদন্ত রিপোর্টে ধুলো জমতে থাকে।

এরপর হঠাৎই ক্রিস্টাল ফিরে এল। কিন্তু কেন ফিরে এলেন ক্রিস্টাল? কেনই বা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন? সিন্থিয়ার মনে ঘোরাফেরা করে প্রশ্নগুলো। বাকি তিন ভাইবোন বা প্রতিবেশী- সকলের সঙ্গেই তো বেশ সহজ সম্পর্ক ছিল ক্রিস্টালের। এর উত্তরটা পেতে গেলে ফিরে তাকাতে হবে বহু বছর আগে। সিন্থিয়া যেমনটা ভাবতেন, তেমনটা একেবারেই ছিল না ক্রিস্টাল। ভাইবোন-স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে তার মেলামেশাটা মোটেও সহজ ছিল না। আসলে মানসিকভাবে তীব্র যন্ত্রণায় ছিলেন তিনি। হাসিখুশি ক্রিস্টালের জীবনের ভয়ঙ্কর বাস্তবটা আর কেউ জানতেন না। তার মা-ও নন!

সিন্থিয়া ফিরে যান তার নয় বছর বয়সে। প্রথম বার যখন তাকে এক প্রতিবেশী ধর্ষণ করে। এরপর আবার এক বার। এরপর বার বার। পরের বছরগুলোতে সেটাই যেন এক প্রকারের নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। এক সময় নাবালিকা ক্রিস্টাল কিশোরী হয়। তবে সেই নিয়মে ছেদ পড়ে না। ক্রিস্টাল কাউকে কিছু বলতে পারে না। এক সময় ভাবতে শুরু করে, এসব কথা তার মা জানে। এত বছর পর মায়ের মুখোমুখি হয়ে সে কথা জানায় ক্রিস্টাল।

‘কোনও মা এমনটা জেনে চুপ করে থাকতে পারে?’ শিউরে উঠে বলেন সিন্থিয়া। এপ্রিলে সেই শনিবার মায়ের কথা না শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল ক্রিস্টাল। বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে করতে রাত ১২টা বেজে গিয়েছিল। ‘ব্যস! আর বাড়ি ফিরব না আমি।’ হঠাৎই মনস্থির করে ফেলে সে।

বাল্টিমোর থেকে সে রাতেই নিউইয়র্কের বাসে উঠে পড়ে সে। ভোরবেলা নিউইয়র্কের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে। সঙ্গে টাকাপয়সা নেই, আশ্রয়হীন। তবে ক্রিস্টালের ভয়ডরও ছিল না। নিউইয়র্কেই রাস্তায় ঘুমোত সে। এর বেশ কিছু বছর পর এক দিন আপার ম্যানহাটনের মতো অভিজাত জায়গায় পৌঁছে যান। নতুন পরিচয় নেন।

২৩ বছরের তরুণী আর ক্রিস্টাল হাগ হয়ে যান ক্রিস্টাল স্যান্ডার্স। নিজের জন্য কেন এই নাম বাছাই করেছিলেন, তা আর মনে নেই ক্রিস্টালের। তবে মনে আছে, বেঁচে থাকার জন্য লোকজনের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছু করেছেন। ডমিনিকান পাড়ায় থাকার সময় এক বার অন্তঃসত্ত্বাও হয়ে পড়েন। নিউইয়র্কে আইনের ফাঁক গলে মেডিক্যাল কার্ডও বার করে নেন। সেই সঙ্গে ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স। এরপর বহু বছর গড়িয়েছে। চার সন্তানের মা হয়েছেন ক্রিস্টাল। প্রতিবেশীদের অনেককেই নিজের দাদা-দাদি, ভাই-বোন হিসেবে ফেসবুকে পরিচয় দিতে শুরু করেছেন।

২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি, যখন তার বয়স আসলে ৩১, সে সময় ইনস্টাগ্রামে কেক নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন, ‘হ্যাপি ফোর টু মি!!!’ সে সময় অবশ্য ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ জুটিয়ে নিয়েছেন। তবে নিজের বড়সড় চেহারার জন্য বয়সটা বাড়িয়ে বলতেন সকলকে।

এত কিছুর মধ্যে ফেসবুকে নিজের মা-ভাইবোনেদের ছবি দেখতে ভুলতেন না ক্রিস্টাল। তার ২০ বছরের ছেলে বার বার ক্রিস্টালের আসল পরিবারের কথা জানতে চাইতেন। অবশেষে এক দিন নিজের আসল পরিবারের কাছেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ক্রিস্টাল।

মেয়ের সব কথা শুনে একেবারে স্তম্ভিত সিন্থিয়া। তবে এত বছর কেটে গেলেও মায়ের প্রতি টান কমেনি ক্রিস্টালের। তাই ফিরে এসেছেন তিনি।

ক্রিস্টালের ফিরে আসার পর এক বছর গড়িয়ে গেছে। বাল্টিমোরে এক আত্মীয়ের সঙ্গেই থাকেন ক্রিস্টাল। আর সিন্থিয়া এখন তার ঘর ছেড়ে বাইরে বের হন। মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে যে। আর অপেক্ষা করতে হবে না তাকে। তবে একটাই আক্ষেপ রয়ে গেছে ৬১ বছরের সিন্থিয়ার মনে, ‘যদি মেয়ের আরও কাছের হতে পারতাম!’

 

 

টাইমস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ১৬০০ মিটার দৌড় : দুই তারকা ক্রিকেটারসহ অনুপস্থিত পাঁচ Apr 20, 2024
img
তীব্র তাপদাহে পুড়ছে দেশ, যশোরে রেকর্ড তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি Apr 20, 2024
img
লেবুপানি খাবেন যে কারণে Apr 20, 2024
img
চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪২.৩, হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু Apr 20, 2024
img
সর্বোচ্চ বাড়িয়ে কমল স্বর্ণের দাম Apr 20, 2024
img
উপজেলা নির্বাচনকালে আ.লীগের সব রকম কমিটি গঠন ও সম্মেলন বন্ধ : কাদের Apr 20, 2024
img
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন : ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪০৭ Apr 20, 2024
img
পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার রেকর্ড ২৭ বস্তা টাকা Apr 20, 2024
img
মালয়েশিয়ায় শোষণের শিকার বাংলাদেশি শ্রমিকরা : জাতিসংঘ Apr 20, 2024
img
শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর, সাধারণ সম্পাদক ডিপজল Apr 20, 2024