আজ থেকে তিন মাস ২১ দিন আগের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন ব্রিটিশ তরুণী গ্রেস মিলান(২২)। বেড়াতে এসে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড থেকে ১ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন গ্রেস। ৯ ডিসেম্বর অকল্যান্ডের একটি ঝোপ থেকে পাওয়া যায় তার মরদেহ। গ্রেস হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয় ২৬ বছর বয়সী এক যুবককে। এই হত্যা মামলা এখন অকল্যান্ডের ডিস্ট্রিক্ট আদালতে বিচারাধীন।
এমন একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যদি বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশে ঘটত তাহলে সেই দেশের রাষ্ট্রনায়করা কতটুকু মাথা ঘামাতেন? সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না। তবে নিউজিল্যান্ডের ঘটেছিল ভিন্ন ঘটনা। গ্রেসের বাবাকে ব্রিটেন থেকে নিয়ে আসা হয় নিউজিল্যান্ড।
গ্রেসির মরদেহ পাওয়ার এক দিন পর ১০ ডিসেম্বর টেলিভিশনে বক্তৃতা রাখেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে গ্রেসির পরিবারের কাছে ক্ষমা চান তিনি।
তিনি বলেন, ‘নিউজিল্যান্ডের পক্ষ থেকে আমি গ্রেসের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আপনাদের মেয়ে এখানে নিরাপদে থাকার কথা ছিল কিন্তু থাকেনি। আমি এর জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমার ভাবনা ও প্রার্থনা গ্রেসের বাবা ডেভিডের কাছে, যিনি এখন নিউজিল্যান্ডে আছেন, তার মা, তার বৃহৎ পরিবার, বন্ধু ও প্রিয়জনদের প্রতি।’
এই হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন। তার দেশে ঘটে যাওয়া প্রতিটা দুঃখের ঘটনা যাকে ব্যথিত করে, মর্মাহত করে। প্রতিটা নাগরিকের সুখে যিনি খুশি হন, আবার কারো কষ্ট যেন তার নিজেরই কষ্ট। এমন রাষ্ট্রনায়কই তো চায় প্রতিটা দেশের জনগণ।
ক্রাইস্টচার্চ হামলা
গত শুক্রবার জুমার নামাজের সময় ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদ ও লিনউড মসজিদে মুসল্লিদের ওপর বন্দুকধারী নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিতে পাঁচ বাংলাদেশিসহ ৫০ জন নিহত হন। আহত ৪২ জন। এই হত্যাকাণ্ড কেবল নিউজিল্যান্ডকে ভারাক্রান্ত করেনি, সারা বিশ্বজুড়ে মানুষকে আলোড়িত করেছে।
এই হামলার ঘটনার পর আমরা এক মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, বলিষ্ঠ কণ্ঠের বিশ্ব নেতার আবির্ভাব লক্ষ করলাম। তিনি নিউজিল্যান্ডের তরুণ প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। হামলার পর তার ন্যায়নিষ্ঠ, জোরালো ভূমিকা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে তিনি সবার হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন।
এই হামলার প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তি অস্ট্রেলীয় নাগরিক এবং হামলার শিকার হতাহত ব্যক্তিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা। যাদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিশর, জর্ডান এবং সোমালিয়া আছে।
তাই যখন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর বিবৃতি প্রদানের জন্য হাজির হলেন, তখন শুধু নিউজিল্যান্ডই তার বক্তব্য শুনতে উদগ্রীব ছিল তেমন নয়। সারা বিশ্বের মনোযোগ ছিল সেদিকে। অতি দ্রুত এবং স্পষ্টভাবে এই বন্দুক হামলাকে তিনি ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বর্ণনা করেন।
বহু মানুষ মনে করেন, শ্বেতাঙ্গ কোনো ব্যক্তির দ্বারা এ ধরনের হামলার ক্ষেত্রে (এমনকি সেটা যদি রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাবেও হয়ে থাকে) কর্তৃপক্ষ এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে অনীহা বা অনিচ্ছুক মনোভাবের পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু জাসিন্ডা আরডার্ন দ্রুত ও স্পষ্টভাবে একে 'সন্ত্রাসী হামলা' বলে বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে সে বিষয়ে তার সচেতনতা এবং বিবেচনার বিষয়টি উঠে আসে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের শোক এবং ভীতির প্রতি তার স্বীকৃতি সেখানেই ফুরিয়ে যায়নি। ক্রাইস্টচার্চে ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর স্বজনদের জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা ও সমবেদনা জানান তিনি। সেসময় মাথায় কালো রঙের স্কার্ফ পরেন তিনি- যা তাদের প্রতি শ্রদ্ধারই বহিঃপ্রকাশ।
তিনি মানুষকে একতার বন্ধনে বেঁধেছেন এবং বলেছেন, ‘তারা আমাদের।’ এর কয়েকদিন পরে প্রথমবারের মত পার্লামেন্টে ভাষণ দিয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি সংক্ষিপ্ত কিন্তু দৃঢ় ভাষায় বক্তব্য রাখেন যেখানে ইসলামি কায়দায় সবাইকে সম্ভাষণ জানান– ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে।
তিনি এই সহানুভূতির সঙ্গে বাস্তবসম্মত আইনি ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতির মিশ্রণ ঘটান। হামলার ঘটনার কয়েক ঘণ্টার পরেই তিনি দেশের অস্ত্র আইনে ‘১০ দিনের মধ্যে’ কঠোর সংস্কার আনার বিষয়ে ঘোষণা দেন।
বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি নিউজিল্যান্ড এবং বিশ্ব থেকে বর্ণবাদ ‘বিতাড়িত’ করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ‘সীমানা দিয়ে ভাবলে আমাদের চলবে না।’
জাসিন্ডাম্যানিয়া
জাসিন্ডা আরডার্নের প্রথম বক্তব্যের সূত্র ধরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের পর্যবেক্ষকরা তার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন।
ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানে সুজানে মুর লিখেছেন ‘মার্টিন লুথার কিং বলেছেন সত্যিকারের নেতারা ঐক্য খোঁজে না তারাই ঐক্য তৈরি করে। আরডার্ন ভিন্ন ধরনের ঐক্য, কর্ম, অভিভাবকত্ব ও একতার প্রদর্শন করেছেন।’
‘সন্ত্রাসবাদ মানুষের মাঝে ভিন্নতাকে দেখে এবং বিনাশ ঘটায়। আরডার্ন ভিন্নতা দেখেছেন এবং তাকে সম্মান করতে চাইছেন, তাকে আলিঙ্গন করছেন এবং তার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছেন।’
ওয়াশিংটন পোস্টের ঈশান থারুর লিখেছেন, ‘আরডার্ন তার জাতির শোক এবং দুঃখ এবং তা নিরসনের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছেন।’
এবিসি অস্ট্রেলিয়া ওয়েবসাইটে অ্যানাবেল ক্র্যাব লেখেন, ‘একজন নেতার জন্য ভয়াবহ বাজে খবরের মুখোমুখি হওয়ার পর...আরডার্ন এখনো পর্যন্ত কোনো ভুল পদক্ষেপ নেননি।’
গ্রেস ব্যাক এক বাক্যে ম্যারি ক্লেয়ার অস্ট্রেলিয়াতে যেটা লিখেছেন: ‘একজন নেতা এমনই হয়ে থাকেন।’
নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘জাসিন্ডা আরডার্নের মতো রাষ্ট্রনায়ক দরকার আমেরিকাতে। কিভাবে তিনি একটি নৃশংস ঘটনা সামলেছেন তা থেকে বিশ্বকে শিক্ষা নেয়া উচিত।’
এই ধরনের প্রশংসা বাখ্যা কেবল বিশ্লেষকদের কাছ থেকেই আসছে তেমনটি নয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ ফয়সাল বলেছেন, আরডার্ন পাকিস্তানিদের 'হৃদয় জয়' করেছেন।
মার্টিন লুথার কিং এর স্মৃতি সংরক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত মার্টিন কিং সেন্টার টুইটারে লিখেছে- ‘নিউজিল্যান্ডে একজন নেতার ভালোবাসার পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শনী।’
তার কথা আলোড়িত করেছে নিউজিল্যান্ডের শোকাহত পরিবারের মানুষদের।
নিউজিল্যান্ডে বিবিসির প্রতিবেদক হিউয়েল গ্রিফিথ বলছেন, ‘আরডার্ন এর বক্তব্য-'আমরা এক, তারা আমাদের' ক্রাইস্টচার্চের হতাহত পরিবারের মানুষদের মুখ থেকে শুনেছি।’
এমনকি বিরোধী ন্যাশনাল পার্টির জুডিথ কলিন্স প্রধানমন্ত্রী ‘অসাধারণ’ বলে পার্লামেন্টে উল্লেখ করেছেন।
নিউজিল্যান্ডে রাজনৈতিক বিশ্লেষক কলিন জেমস বিবিসিকে বলেছেন, আরডার্নের সঙ্গে ‘বেশ কিছু সময়’ কাটিয়ে তার মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী যেসমস্ত প্রশংসা বাক্য পাচ্ছেন তা বিস্ময়কর কিছু নয়।
‘তিনি দৃঢ়, গম্ভীর, ইতিবাচক এবং দায়িত্বশীল। যেটা আমি প্রায়ই বলে থাকি যে, তার শরীরে কোন বাজে কোষ নেই, কিন্তু আবার তাকে সহজে প্রভাবিত করা যায় না- এটা একটা ব্যতিক্রমী সমন্বয়।’
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে নিউজিল্যান্ডে সাধারণ নির্বাচন হয়। নির্বাচনে ৩৭ শতাংশেরও কম ভোট পায় জাসিন্ডার লেবার দল। তা সত্ত্বেও তিনি অন্যদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে সক্ষম হন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে জাসিন্ডা বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নারী প্রধানমন্ত্রী হন।
তিনি যখন প্রথম তার নির্বাচনী প্রচার কাজ শুরু করেন তাকে নিয়মিতভাবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে তুলনা করা হতো। এর অর্থ- এই তিনজনই প্রগতিশীল, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং তরুণ।
আরডার্ন যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন তখন তার বয়স ৩৭ বছর। তাকে ঘিরে ব্যাপক উন্মাদনা তৈরি হয় যার নামকরণ করা হয় ‘জাসিন্ডাম্যানিয়া’। তিনি শেষ পর্যন্ত 'অসার পদার্থে পরিণত' হন কি-না তা নিয়ে তখন অনেকেই এমনও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
সুশীল অ্যারোন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় লিখেছেন- ‘তিনি ডানপন্থী শক্তিশালীদের ভিড়ে দৃঢ় প্রগতিশীল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে আসছেন... যার ক্যারিয়ারে গড়ে উঠেছে উদারতাহীন, মুসলিমবিদ্বেষী আড়ম্বরের মধ্যে।’
এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরোধের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় যেখানে আরডার্নকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, 'আমেরিকা কী ধরনের সহায়তা দিতে পারে?’
উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘সকল মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা।’
হামলার পর দিন আরডার্নকে হতাহতদের পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়া যে ছবি দেখা গেছে তাতে রাজনৈতিক সমসাময়িক নেতাদের আচরণের সঙ্গে বৈপরীত্য তুলে ধরে।
আল জাজিরার সাংবাদিক সানা সাইদ বলেছেন, ‘২০১৭ সালে কুইবেক মসজিদে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এতটা গভীর মানবিকতা দেখিয়েছেন বলে মনে পড়ছে না।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘২০১২ সালে উইসকনসিন-এর ওয়াক ক্রিক গুরুদুয়ারায় বন্দুক হামলার ঘটনার পর আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘটনার শিকার লোকজনের মাঝে দেখা করতে যাননি।’
গতবছর একটি বন্দুক হামলার ঘটনায় বিধবা হওয়া একজন নারী এমনকি ট্রুডোকে অপ্রীতিকর কোনো কিছুর অংশ বলে ফোনে মন্তব্য করেন। কারণ তিনি যথেষ্ট সমবেদনা প্রকাশ করেননি বলে ওই নারী মনে করেছেন।
পুরো বিশ্বে যখন রক্তের হলি খেলায় ব্যস্ত তাঁবর নেতারা। ঠিক তখন বিশাল এক শান্তির মশাল জ্বালিয়ে আলোর পথ দেখিয়ে দিলেন নিউজিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন। তাই তো খোদ আমেরিকাতেই এখন দাবি উঠেছে, জাসিন্ডার মতো একজন মানবদরদী নেতা ভীষণ প্রয়োজন তাদের।
টাইমস/এসআই