সৌদিতে দুই ভারতীয় নাগরিকের শিরশ্ছেদ

ভারতীয় দূতাবাসকে না জানিয়ে কারাবন্দি দুই ভারতীয় নাগরিকের শিরশ্ছেদ করেছে সৌদি প্রশাসন। প্রায় দেড় মাস পর তাদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিং। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে যাবেন বলেও জানিয়েছেন।

কর্মসূত্রে কয়েক বছর আগে সৌদি আরব গিয়েছিল হোশিয়ারপুরের সফদরপুর কলিয়াঁ গ্রামের বাসিন্দা সতবিন্দ্র সিং এবং লুধিয়ানার মচ্ছিওয়ারার বাসিন্দা হারজিৎ সিং। সেখানে মাতাল অবস্থায় মারামারি করে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে কারাদণ্ড হয় তাদের। হাজতবাস শেষ হলে দাম্মাম জেল থেকে ভারতে ফেরত পাঠানোর সময় তাদের আঙুলের ছাপ নেয়া হয়। তাতে একটি খুনের মামলাতেও তাদের যোগ রয়েছে বলে ধরা পড়ে।

ওই দু’জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আরেক ভারতীয় নাগরিক আরিফ ইমাম উদ্দিনের সঙ্গে মিলে সৌদিতে ডাকাতি এবং লুঠপাট চালাত তারা। লুটের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ বাধলে ইমাম উদ্দিনকে খুন করেন তিনি। সেই ঘটনায় ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর তাদের গ্রেপ্তার করে রিয়াদ জেলে নিয়ে যায় সৌদি প্রশাসন। তদন্ত চলাকালীন সেখানে অপরাধ কবুল করে তারা। তারপর মহাসড়কে ডাকাতির চার্জও গঠন হয় তাদের বিরুদ্ধে।

সৌদি আরবে খুন এবং ডাকাতি, দুই অপরাধেই মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। গত তিনবছর ধরে সেখানে কারাবন্দি ছিলেন তারা। সেই অবস্থাতেই গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তাদের শিরশ্ছেদ করা হয়।

এক অচেনা ব্যক্তি ২ মার্চ ফোনে সতবিন্দ্রের পরিবারকে তার মৃত্যুর খবর দেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। বাধ্য হয়ে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন সতবিন্দ্রের স্ত্রী সীমারানি। স্বামী আদৌ বেঁচে রয়েছে, না মারা গেছে সরকারকে তা নিশ্চিতভাবে জানাতে হবে বলে আবেদন জানান তিনি। বিষয়টি নিয়ে গত ৮ এপ্রিল কেন্দ্রীয় সরকারকে নোটিশ দেয় আদালত। তারপর চলতি সপ্তাহের মঙ্গলবার লিখিত জবাব জানায় কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাতে সতবিন্দ্র ও হারজিতের শিরচ্ছেদের খবর নিশ্চিত করা হয়।

ডিরেক্টর (কনসুলার) প্রকাশ চাঁদ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘২৮ ফেব্রুয়ারি সতবিন্দ্র ও হারজিতের শিরশ্ছেদ করা হয়। রিয়াদে আমাদের দূতাবাসকে তা আগে থেকে জানানো হয়নি। বরং ওইদিন সন্ধ্যায় ফ্যাক্সের মাধ্যমে কূটনৈতিক নোট পাঠিয়ে শিরশ্ছেদ করা হয়েছে বলে জানানো হয়।’

চিঠিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ৩ মার্চ সতবিন্দ্র ও হারজিতের মৃতদেহ সম্পর্কে তথ্য পেতে ভারতীয় দূতাবাসের তরফ থেকে সৌদি প্রশাসনকে আবেদন জানানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব মেলেনি। যার পর ১৪ মার্চ আবার অনুরোধ করা হয়। এখন পর্যন্ত জবাব আসেনি। সেই সঙ্গে সতবিন্দ্র ও হারজিতের দেহ ফিরে পাওয়ার কোনো আশা নেই বলেও জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বিভিন্ন সূত্রের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সৌদি আইনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারো দেহ তাদের পরিবার, দূতাবাস বা দেশের হাতে তুলে দেয়ার নিয়ম নেই।

আনন্দবাজার জানায়, ৩ মার্চ সতবিন্দ্রের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরও, তার পরিবারকে খবর দিতে এতদিন সময় লেগে গেল কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। গোটা ঘটনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিং।

তিনি বলেন, ‘কোনো রকম আইনি সহায়তা ছাড়া, ভারতীয় দূতাবাসকে না জানিয়ে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো। এই ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত নিদর্শন।’ বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের বিশ্ব মানবাধিকার বিভাগের দ্বারস্থ হবেন বলেও জানান তিনি।

এই ধরনের প্রাচীন, বর্বর এবং বেআইনি আচরণ বন্ধ করতে সৌদি আরবের ওপর চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন বলেও জানান অমরেন্দ্র। মৃতদের দেহ ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হবে বলেও দাবি তোলেন তিনি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন সতবিন্দ্রের স্ত্রী সীমারানিও।

তিনি বলেন, ‘২০১৬ থেকে মামলাটি চলছিল। তা সত্ত্বেও আমার স্বামীর জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।’ পাঞ্জাবের একাধিক মন্ত্রী ও সাংসদের দ্বারস্থ হলেও কেউ তাকে সাহায্য করেননি, একমাত্র হোশিয়ারপুরের লোকসভা সাংসদ অবিনাশ রাই খন্না তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে সাহায্য করেছিলেন বলেও দাবি করেন তিনি। 

সীমারানি আরও বলেন, ‘২ ফেব্রুয়ারি ফোনে স্বামীর সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল। ১ মার্চ অচেনা এক ব্যক্তি ফোন করে আমাকে ওর মৃত্যুর খবর দেন। ২ মার্চ আবার ফোন করেন তিনি। ২৮ ফেব্রুয়ারি সৌদির কারা কর্তৃপক্ষ ওর শিরশ্ছেদ করেছে বলে জানান। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি আমরা। কিন্তু আমার স্বামীর মৃত্যুর খবরটুকু পর্যন্ত নিশ্চিত করার প্রয়োজন বোধ করেনি ওরা।’

সতবিন্দ্রের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, হোশিয়ারপুরের বাড়িতে মেয়ে, স্ত্রী ও মা-বাবাকে রেখে ট্রাক ড্রাইভার হিসেবে দু’বছরের চুক্তিতে ২০১৩ সালে সৌদি আরব যায় সে। দু’-তিনমাস অন্তর সেখান থেকে ফোন করত বাড়িতে। তার গ্রেপ্তার হওয়ার খবরও বেশ কয়েকমাস পর জানতে পেরেছিল পরিবারের লোকজন। সৌদি যাওয়ার আগে দু’বছর কুয়েতেও ছিল সে।

 

 

টাইমস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img
কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন শেখ হাসিনা Apr 19, 2024
img
প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন : অর্থমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে গেল বাস, প্রাণ গেল প্রকৌশলীর Apr 19, 2024
img
চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি Apr 19, 2024
img
৩টি ড্রোন ধ্বংস করল ইরান, ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনা নিরাপদ Apr 19, 2024
img
সবজির বাজার চড়া, কমেনি মুরগির দাম Apr 19, 2024
img
‘যারা নুন-ভাতের চিন্তা করতে পারত না তারা মাছ-মাংসের চিন্তা করে’ Apr 19, 2024
img
ইরানে ইসরায়েলি হামলা, লাফিয়ে বাড়ল তেল ও স্বর্ণের দাম Apr 19, 2024
img
ঢাকাসহ ৬ বিভাগে ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস Apr 19, 2024
img
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এলেন আরও ১৩ বিজিপি সদস্য Apr 19, 2024