ঝিনাইদহে স্বাস্থ্য বিভাগের জীপে চড়ে এলো করোনা!

ঝিনাইদহ স্বাস্থ্য বিভাগের স্বজনপ্রীতির কারণে হিসেবে পাল্টে গেলো। প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্তদের বড় একটি অংশ ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী। অনেকে স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টিনে চলে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। ইতিমধ্যে শৈলকুপা ও কালীগঞ্জের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে করে জেলার চিকিৎসা সেবা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। কেন এমন হলো? উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে আসল রহস্য!

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যানবিদ জাহাঙ্গীর হোসেনের দেওয়া তথ্য মতে, জেলায় ২৫ এপ্রিল প্রথম দুইজন করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। এদের একজন জেলা শহরের পাগলাকানাই সড়কের বাসিন্দা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা এবং অপরজন কালীগঞ্জ উপজেলার মোল্লা ডাঙ্গা গ্রামের দিনমুজুর। একই দিন ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যায় শৈলকুপা উপজেলার ১৪ বছর বয়সের এক শিশু।

এদিকে করোনা ধরা পড়ার পরেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় ঝিনাইদহ জেলা করোনা মুক্ত বলে দাবি করে। পরের দিন ২৬ এপ্রিল জেলায় শনাক্ত হন ৯ জন। এ দিনেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেস ব্রিফিংয়ে একই কথা বলা হয়। ২৭ এপ্রিল ৪ জন, সব শেষ ২৮ এপ্রিল আরো ৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়।

আক্রান্তদের মধ্যে ডাক্তার, নার্স, ড্রাইভার, রাধুনীসহ স্বাস্থ্য বিভাগের ১৩ জন। শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত একজন ডাক্তারসহ অন্তত ৬ জনের শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। এ ঘটনার অন্তরালে লুকিয়ে আছে স্বজনপ্রীতি ও চরম দায়িত্বহীনতার খবর।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারাদেশ করোনা ঝুঁকি ঘোষণা করা হলেও থেমে থাকেনি স্বাস্থ্য বিভাগের নতুন জীপ হস্তান্তরের কার্যক্রম। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের জন্য কেনা হয়েছে দামি জীপ গাড়ি। সূত্র মতে, ঝিনাইদহ জেলার ৩ উপজেলাতে আগেই জীপ দেওয়া হয়েছে। বাকি ছিল আরো ৩টি। এ গুলো হচ্ছে- শৈলকুপা, মহেশপুর এবং ঝিনাইদহ সদর উপজেলা। ওই ৩টি জীপের একটিতে চড়ে করোনা ঢুকে পড়েছে জেলা শহর এবং শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ৩টার দিকে একটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেটকার স্থানীয় আরিফ ফিলিং স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। মাইক্রোবাসটি (ঝিনাইদহ-চ’১১-০০০৩) ঝিনাইদহ ভেটেরিনারি কলেজের। এর চালক ছিলেন আব্দুল আলীম। মাইক্রোতে যাত্রী ছিলেন সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডাক্তার সাজ্জাদ হোসেন। তাকে নিজ বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়। একই দপ্তরের আউট সোর্সিং গাড়ি চালক কানু বিশ্বাস এবং তার বড় ভাই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের গাড়ি চালক বাদশা বিশ্বাস, মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডা. আকবার নেওয়াজ এবং আউটসোর্সিং ড্রাইভার তারা মিয়া।

শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাশেদ আল মামুনের দেওয়া তথ্য মতে, অপর একটি প্রাইভেটকারে চড়ে যান তার ব্যক্তিগত গাড়ি চালক সোহেল রানা, স্টোর কিপার মাসুদ রানা, আউট সোর্সিং ড্রাইভার অহিদ সাদিক উজ্জল এবং ডাক্তার আকাশ আহম্মেদ আলিফ।

সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ড্রাইভার কানু বিশ্বাস জানায়, ২০ এপ্রিল সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে কেন্দ্রীয় ঔষধ ভাণ্ডারে পৌঁছান তারা। একই দিন রাত আনুমানিক ৯ টার দিকে সে এবং তার বড় ভাই এবং সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাকে নিয়ে নতুন জীপে চড়ে ঝিনাইদহে ফিরে আসেন। জীপ চালান তার ভাই বাদশা। অন্য দুইটি নতুন জীপ এবং ভেটেরিনারি কলেজের মাইক্রোটি আলাদাভাবে ঢাকা ত্যাগ করে। পরে সে জানতে পারে শৈলকুপার জন্য বরাদ্দ দেওয়া নতুন জীপে করোনা আক্রান্ত একজন নারী যাত্রী ও তার স্বামীকে বহন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাশেদ আল মামুন দাবি করেছেন, করোনা রোগী বহনের খবর সঠিক নয়। তবে নতুন জীপের ড্রাইভারসহ সব যাত্রী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন মর্মে স্বীকার করেন তিনি।

এই কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য মতে, তার দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিসংখ্যানবিদ বখতিয়ারের নিকট আত্মীয় ওই নারী রোগীর স্বামী। নতুন জীপে তাকে নয়, তার ব্যাগপত্র বহন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।

বিশেষ একটি সূত্র থেকে জানা যায়, শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ড্রাইভার সোহেল রানার জীপে ঢাকার একটি বাসা থেকে করোনা পজেটিভ একজন স্কুল শিক্ষিকা ও তার স্বামীসহ কয়েকজনকে যাত্রী হিসেবে বহন করা হয়। তাদের মধ্যে স্কুল শিক্ষিকা ও তার স্বামীকে ঝিনাইদহ জেলা শহরের মহিলা কলেজ পাড়ার একটি বাড়িতে নামানো হয়। রাতেই ওই এলাকার লোকজনের মাঝে খবর ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি জানতে পেরে পরের দিন ২১ এপ্রিল জেলা শহরের পাগলাকানাই সড়কে নিজ বাড়িতে চলে আসে তারা। এরপর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন ডিনারের নেতৃত্বে ৬ সদস্যর একদল স্বাস্থ্যকর্মী এসে বাড়িটি ১৪ দিনের জন্য হোম কোয়ারেন্টিনের পোষ্টার সেটে দেয়। ২২ এপ্রিল নমুনা সংগ্রহ করা হয় তাদের। ২৫ এপ্রিল স্কুল শিক্ষিকার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়।

২৬ এপ্রিল শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ড্রাইভার সোহেল রানা ও একই দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিসংখ্যানবিদ বখতিয়ার হোসেন ও ৩১ বছর বয়সের তুহিন মালিথা নামের এক ব্যক্তির শরীরে করোনা ধরা পড়ে। আরো আক্রান্ত হন শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্টোর কিপার মাসুদ রানা, ডেন্টাল সার্জন ডা. জেএম খসরু আল মামুন, বাবুর্চি জগদিস, কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার মৌসুমি, এক্সরে টেকনিশিয়ান শুকুর আলী। সদর উপজেলা স্বাস্থ্য পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন ডিনারও বাদ পড়েননি। অর্থাৎ করোনা পজেটিভ স্কুল শিক্ষিকার সংস্পর্শে আসা জীপের সকল যাত্রী আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি গোটা শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। তবে ঢাকা থেকে ফিরে আসা ডা. আকাশ আহম্মেদের নমুনায় করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি। এমনটি তাকে বহন করা প্রাইভেট কারের চালকেরও করোনা ধরা পড়েনি।

ভেটেরিনারি কলেজের মাইক্রোবাস চালক আব্দুল আলীমও ঢাকা মুহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে একজন নারী ও দুই জন পুরুষ যাত্রী নিয়ে আসে। ২০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৭টার দিকে স্থানীয় ওজির আলী স্কুল এন্ড কলেজ মাঠের কাছে নামিয়ে দেওয়া হয় তাদের। এ খবরের সত্যতা স্বীকার করলেও ওই যাত্রীদের নাম প্রকাশ করেনি সে। এসব ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়।

নতুন জীপে করোনা রোগী বহন করার কারণে শৈলকুপায় ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে জানিয়েছেন তিনি।

পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেছেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। ইতিমধ্যে গোয়েন্দারা কাজ শুরু করেছেন।

জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ বলেছেন, আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করার ফলে করোনা ঝুঁকির বাইরে ছিল এ জেলার মানুষ। এখন সব হিসেবে পাল্টে গেছে।

তিনি আরো বলেন, শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার জন্য বরাদ্দ করা জীপে করোনা আক্রান্ত নারী স্কুল শিক্ষককে বহন করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, রেফার করা রোগী ঢাকাতে নেওয়ার অজুহাতে স্বাস্থ্য বিভাগসহ প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারিপুরসহ করোনা আক্রান্ত জেলা গুলো থেকে অসংখ্য নারী পুরুষ এ জেলায় ঢুকে পড়েছে। তারা উপসর্গ গোপন করে হাসপাতাল গুলোর বহির বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসছে এবং নিরবে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। যে কারণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে করোনা। এছাড়াও মানসম্মত মাস্ক ও পিপিই না থাকায় আক্রান্ত হচ্ছেন ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, বুধবার কালীগঞ্জ শৈলকুপা এবং কোটচাঁদপুরের ৩৩ জন ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্য কর্মীর নমুনা পরীক্ষা করে নেগেটিভ ফলাফল পাওয়া গেছে।

সিভিল সার্জনের অফিস সূত্র জানায়, মঙ্গলবার পর্যন্ত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে ৪৩৭ টি নমুনা। এখন পর্যন্ত ২১৯ টির ফলাফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২১ জনের করোনা পজেটিভ ধরা পড়েছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের নড়বড়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারণে করোনা ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

টাইমস/মিজানুর/এইচইউ

Share this news on: