ঝিনাইদহে স্বাস্থ্য বিভাগের অনুদানের টাকা বিএনপি নেতাদের পকেটে

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুদান খাতে ঝিনাইদহে বরাদ্দ করা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কমিশন বাণিজ্যর সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট। নাম স্বর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের (এনজিওর) নামে প্রতিবছর বরাদ্দ দেয়া সরকারি অর্থ কোনো কাজেই আসছে না। ঝিনাইদহের দুই বিএনপি নেতা এবং জেলা স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত সিসিটি (কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান) ২০১৯-২০ অর্থবছরে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ঠিক সেসময় বেরিয়ে এলো এমন চাঞ্চল্যকর এ খবর। এসব অভিযোগ তদন্তে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দরা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দপত্র সুত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বিশেষ অনুদান খাতে ১১ কেটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। এই টাকা ‘মা ও শিশু স্বাস্থ্য’ এবং ‘স্বাস্থ্য ও পুষ্টি’ খাতে সারাদেশের ২০৪৬টি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) অনুকুলে বিভাজন করা হয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে ৬৭৫টি এনজিওর অনুুকুলে চার কোটি পঞ্চাশ লাখ এবং স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে ১৩৭১টি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) অনুকুলে ছয় কোটি পচানব্বই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলায় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে ৫৪টি এবং পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে ৫৪টি এনজিওর অনুকুলে প্রায় পোনে এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। চলতি বছরের জুন মাসের বিভিন্ন তারিখে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে বরাদ্দকৃত অর্থের চেক গ্রহণ করে এনজিওগুলো। জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের দায়িত্বশীল একটি সুত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এছাড়া অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডাঃ সেলিনা বেগম ৫৩টি এবং পরিবার কল্যাণ বিভাগের উপ-পরিচালক ডা. জাহিদ হোসেন ৫২টি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দাখিল করা টিআর বিলে অনুমোদন দিয়েছেন। এর মধ্যে একই এনজিও উভয় বিভাগ থেকে অনুদানের অর্থ গ্রহণ করেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঝিনাইদহ জেলা কৃষক দলের সাবেক সভাপতি বর্তমান আহবায়ক অনোয়ারুল ইসলাম বাদশার পরিচালনায় বেনামী একাধিক এনজিও রয়েছে। তিনি ঝিনাইদহ জেলা বাউল সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে (স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের) স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে ৫০ হাজার টাকার চেক ১১ জুন (টোকেন নাম্বার ০২৯৮৮৩) জেলা হিসাবরক্ষণ দপ্তর থেকে গ্রহণ করেছেন।

এছাড়া ৯ জুন একই ব্যক্তি ‘সেভ ঝিনাইদহ’ নাম ব্যবহার করে পরিচালকের স্বাক্ষর সিল দিয়ে (টোকেন নাম্বার ০২৯৫৩১) ৫০ হাজার এবং শুধু মাত্র ভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করে একই প্রতিষ্ঠান সেভ এনজিওর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে (টোকেন নাম্বার ০২৯৮৭৪) আরও ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন। এখানেই শেষ হয়নি বাদশার দুর্নীতি। জেলা কৃষক দলের এ নেতা ২৮ জুন জেলা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের (স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়) বরাদ্দকৃত ৫০ হাজার টাকার পৃথক আরেকটি চেক জেলা বাউল সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে (টোকেন নাম্বার ০৩৩১৭৯) গ্রহণ করেছেন।

জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারের অনুদানের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে কৃষক দল নেতা আনোয়ারুল কবির বাদশা বলেন, প্রথমবারের মত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে এতগুলো টাকা বরাদ্দ পেয়েছি।

সরকারের কাছ থেকে নেয়া অনুদানের টাকা দিয়ে কি কাজ করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিভিল সার্জন দপ্তর থেকে পাঁচ হাজার টাকার মত জিনিসপত্র চেয়ে ফোন করা হয়েছে। সে গুলো কিনে দেব।

এদিকে এনজিওর নাম ভাঙিয়ে সরকারের অর্থ তছরুপ করার সিন্ডিকেটের সক্রিয় আরেক সদস্যের নাম উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। ঝিনাইদহ বিএনপির নেতা সাহাজান আলী বর্তমানে সদর পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনিও নামমাত্র এনজিও খুলে সরকারের বরাদ্দকৃত বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের নেশায় মেতেছেন।

জানা গেছে, ঠিকাদারি ব্যবসায়ী সাহাজান আলীর নামে রয়েছে ‘সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ নামে একটি এনজিও। সদ্য সমাপ্ত অর্থ বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে এই এনজিওর নামে ৭৫ হাজার টাকার অনুদান পেয়েছেন তিনি। তবে কোন খাতে ওই টাকা ব্যয় হয়েছে তার হদিস মেলেনি।

এব্যাপারে সাহাজান আলী বলেন, বরাদ্দের টাকা দিয়ে স্বাস্থ্য সেবার কাজ করে থাকি। এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।

এদিকে ঝিনাইদহ জেলা পরিবার কল্যাণ বিভাগে পরিচালিত অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আরও ভয়াবহত তথ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলা পরিবার কল্যাণ বিভাগ (সাবেক পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর) থেকে গত ২৪ জুন ‘সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ নামের ওই এনজিওর ম্যানেজার পরিচয়ে আষিশ মৌলিক নামে একব্যক্তি স্বাক্ষর করে ১১টি এনজিওর বিল ভাউচার বুঝে নিয়েছেন।

এব্যাপারে ফেডারেশন অব এনজিও ইন বাংলাদেশের (এফএনবি) সভাপতি পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, মন্ত্রাণালয় থেকে টাকা পয়সা খরচ করে বরাদ্দ আনতে হয়।

অপর দিকে জেলা শহরের কবি গোলাম মোস্তফা সড়কে রয়েছে আল-মামুন জেনারেল হাসপাতাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেছেন স্বাস্থ্য বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। বিধি মোতাবেক এটি হাসপাতাল, এনজিও নয়। অথচ প্রতিষ্ঠানটির নামে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে।

ঝিনাইদহ জেলার আনাচে-কানাচে গজিয়ে উঠেছে এরকম অসংখ্য অস্থিত্বহীন ও নাম স্বর্বস্ব এনজিও প্রতিষ্ঠান। এসব ব্যাপারে কালীগঞ্জ উপজেলার ‘সেভ’ (সার্ভিস অ্যান্ড ভিশন ফর এডিফাই) নামের অন্য একটি এনজিওর নির্বাহী পরিচালক দারু হোসেন খান বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার জন্য আগে থেকে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে হয়। এরপর টাকার চেক হাতে পেয়ে সিন্ডিকেট সদস্যদের হাতে পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী কমিশনের টাকা তুলে দিতে হয়। সারাদেশে নানা দলে বিভক্ত হয়ে এ চক্রটি কাজটি করে থাকে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে অনুদান পাওয়ার জন্য স্থানীয় ভাবে প্রথমে ঝিনাইদহ জেলা সিভিল সার্জনের দপ্তরের হাবিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করে এনজিও মালিকরা। এই হাবিবুর রহমানই ঝিনাইদহে অনুদান বাণিজ্যের নাটের গুরু। তিনি মুলত জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সিসিটি (কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান) হিসেবে কর্মরত। তার কাজ হচ্ছে সরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে থাকা ফ্রিজসহ যন্ত্রপাতি মেরামত করা।

কিন্তু এনজিও সংক্রান্ত ফাইলের কাজ তাকে দিয়ে করানো হয়। অনুদান প্রাপ্তির জন্য ভুয়া প্রকল্প, কাগজপত্র, আবেদন সব কিছইু করে দেন হাবিবুর। বিনিময়ে চেক পাওয়ার পরে কমিশনের ২০ থেকে ৩০ ভাগ পান তিনি।

জানা গেছে, আজম নামে হাবিবুর রহমানের এক ভাতিজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন। ওই আজমের মাধ্যমেই স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উচ্চপর্যায়ে দেন দরবার করেন হাবিবুর রহমান। এমনকি হাবিবুরের নিজের নামেও একাধিক এনজিও রয়েছে।

এসব ব্যাপারে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘শ্রোতধারা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ নামে আমার স্ত্রীর নামে এনজিও রয়েছে। আমার নামে কোনো এনজিও নেই। অনুদান বাণিজ্যের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

এসব অভিযোগের বিষয়ে ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম বলেন, ঝিনাইদহে নামে বেনামে অসংখ্য অস্তিত্বহীন এনজিও সংস্থা রয়েছে। নামমাত্র সংস্থার আড়ালে সরকারি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। এসব অপকর্মের সঙ্গে স্থানীয় সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন পেশার প্রভাবশালী লোকজন রয়েছেন। তাদের চাপে ভুয়া টিআর বিলে স্বাক্ষর করেছি।

তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, সিভিল সার্জন এসব অনিয়ম জানা সত্বেও অনুদানের চেক সই করেছেন। তবে তিনি এনজিওগুলোর প্রতি শর্ত দেন যে, মাস্ক, পিপিই ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী দিতে হবে। এই শর্ত মেনেই তিনি চেক হস্তান্তর করেছেন।

এব্যাপারে জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম বলেন, আমরা জানি যে, এই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বরাদ্দের টাকা দিয়ে কোন কাজই করবেনা। তাই করোনা দুর্যোগে পিপিই মাক্সসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী নেয়ার প্রস্তাব করা ছাড়া উপায়ই বা কি? সবই তো চলে যাবে, তারপরও যদি কিছু পাওয়া যায়। তাই এ শর্ত দেয়।

এসব ব্যাপারে জেলা পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, এসব অভিযোগ তদন্তের জন্য গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে তারা মাঠে কাজ শুরু করেছেন।

 

টাইমস/এফএ/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জাহাজসহ জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে সরকার অনেক দূর এগিয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী Mar 28, 2024
img
ঢাবির কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটের ফল প্রকাশ, ৮৯.৯৩ শতাংশ ফেল Mar 28, 2024
img
একনেকে ৮ হাজার ৪২৫ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন Mar 28, 2024
img
রাজসিক সংবর্ধনায় দায়িত্ব নিলেন বিএসএমএমইউ'র নতুন উপাচার্য Mar 28, 2024
img
রোদে পোড়া ত্বকের যত্নে হলুদের ঘরোয়া প্যাক Mar 28, 2024
img
শহরের চেয়ে গ্রামে বিয়ে-তালাক বেশি Mar 28, 2024
img
ময়মনসিংহে বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৫ Mar 28, 2024
img
বাংলাদেশে মুক্ত গণতন্ত্র বাস্তবায়নে সমর্থন অব্যাহত থাকবে: ম্যাথিউ মিলার Mar 28, 2024
img
নিউইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত Mar 28, 2024
img
নিষেধাজ্ঞার ৩ দিনের মধ্যে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রস্তাব অনুমোদিত Mar 27, 2024