ফায়ার হাইড্রেন্ট: আগুন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পানির উৎস

আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বহু আগে থেকেই ব্যবহৃত একটি পদ্ধতির নাম ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’। এটি মূলত রাস্তার ধারে ধারে থাকা এক ধরনের পানির কল, যা থেকে জরুরী প্রয়োজনে পানি সরবরাহ করা যায়।

প্রায় দুইশত বছর আগে এটি আবিষ্কৃত হয়। তবে বাংলাদেশে এখনও এই ব্যবস্থাটির ব্যবহার দেখা যায় না।

ফায়ার হাইড্রেন্টেকে ফায়ার প্লাগ, ফায়ার পাম্প, কিংবা শুধু পাম্প ইত্যাদি বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। এটি মাটির উপরে কিংবা নীচে দুই পদ্ধতিতেই স্থাপন করা যায়। এটি দুই ধরণের হয়ে থাকে। একটি হল ‘ওয়েট ব্যারেল ফায়ার হাইড্রেন্ট’। এতে অবিরত পানি সরবরাহ থাকে। অন্যটি হল ‘ড্রাই ব্যারেল ফায়ার হাইড্রেন্ট’। এ ধরণের পাম্পে বৈদ্যুতিক যন্ত্র বা ঢাকনি দ্বারা পানি সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। প্রয়োজনের সময় ঢাকনি সরিয়ে দিলে বা বৈদ্যুতিক যন্ত্র চালু করলে পানি সরবরাহ হয়।

ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে পানির একটি সংযোগ উৎস, যা পানির প্রধান উৎসের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যে কোনো জরুরী প্রয়োজনে এই উৎস থেকে পানি সরবরাহ করা যায়। তবে এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে- এর সঙ্গে লম্বা পাইপ যুক্ত করে ইচ্ছেমত যে কোনো দূরত্বে পানি সরবরাহ করা যায়।

তাই বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় শহরে অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা হিসেবে এই প্রযুক্তির প্রচলন রয়েছে। দেখা যায়, সাধারণত বড় বড় শহরগুলোর বিভিন্ন রাস্তায় ফায়ার হাইড্রেন্ট বা পানির পাম্প স্থাপন করা হয়। কোথাও আগুন লাগলে এই পাম্প থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হয়।

সাধারণত দেখা যায়, শহর এলাকায় এমন কিছু সরু রাস্তা থাকে, যেখান দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। এমতাবস্থায় এসব এলাকায় আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে এসব এলাকায় ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা থাকলে লম্বা পাইপ দিয়ে প্রয়োজন অনুসারে পানি সরবরাহ করা যায়। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণ সহজ হয় এবং ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমানো সম্ভব হয়।

ফায়ার হাইড্রেন্ট প্রযুক্তির উদ্ভাবন নিয়ে সুস্পষ্ট তথ্য জানা যায়নি। তবে প্রচলিত ধারণা থেকে জানা যায়, ১৮০১ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার প্রধান প্রকৌশলী ফ্রেডরিক গ্রাফ অগ্নিনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কৌশল হিসেবে ফায়ার হাইড্রেন্ট উদ্ভাবন করেন। কিন্তু ১৮৩৬ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত প্যাটেন্ট কার্যালয় আগুনে পুড়ে গেলে বেশ কিছু প্যাটেন্ট সম্পর্কিত দলিলপত্র নষ্ট হয়ে যায়। তাই ফায়ার হাইড্রেন্টের উদ্ভাবক হিসেবে প্রমাণক দলিলপত্র পাওয়া যায়নি।

যাই হোক, আবিষ্কারের প্রথম দিকে শহরে পানি সরবরাহের কাজে ফায়ার হাইড্রেন্টের প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এটি আগুন নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮৬৫ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে লোহার তৈরি ফায়ার হাইড্রেন্টের প্রচলন শুরু হয়। ১৮৭০ সালের দিকে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে এর ব্যবহার শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে ইউরোপের অন্যান্য দেশে এটি ছড়িয়ে পড়ে।

এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে জাপান ১৮৮৭ সালে ১৩১টি ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করে। এরপর ধীরে ধীরে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ফায়ার হাইড্রেন্টের প্রচলন রয়েছে।

অথচ স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক হতে চললেও এখনও বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির প্রচলন দেখা যায়নি। যদিও প্রতি বছরই দেশের প্রধান শহরগুলোতে বিভিন্ন সময়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ ঢাকার চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রায় ৬৭ জন মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। যা আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এর আগে ২০১০ সালে ঢাকার নিমতলীতেও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল।

একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও এসব দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিকায়ন করা হলেও জনাকীর্ণ এলাকাগুলোতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে সেখানে সময়মত পৌঁছা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে জনাকীর্ণ এলাকায় আগুন নেভানোর জন্য পানি সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায়, এসব এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে।

অথচ এসব এলাকায় অগ্নি নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি সরবরাহ করতে ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা খুব কার্যকর একটি কৌশল হতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রায় দুইশ বছর আগে উদ্ভাবিত হলেও এই প্রযুক্তিটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে স্থাপন করা হয়নি। তাই আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে দেশের প্রধান শহরগুলোতে দ্রুত এই প্রযুক্তির প্রচলন করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on: