জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেছেন, নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অতিরিক্ত উদ্বাস্তু গ্রহণ বাংলাদেশের পক্ষে আর সম্ভব নয়। নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা প্রশ্নে অনেক কথা বললেও পরিস্থিতির আদৌ কোনো উন্নতি হয়নি। অবস্থা যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, এ জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশনে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি অভিযোগ করেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনায় মিয়ানমার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেসব ছিল ‘ফাঁকা বুলি’। এ বিষয়ে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে তারা।
‘একজন রোহিঙ্গাও স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরে যেতে রাজি হয়নি কারণ সেখানে তাদের নিরাপদে বসবাস করার মত পরিস্থিতি মিয়ানমার এখনও তৈরি করেনি।’
মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর গত ১৮ মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তার আগে গত কয়েক দশকে এসেছে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো। তবে মিয়ানমার সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
মিয়ানমার বলে আসছে, তাদের নাগরিকদের মধ্যে যারা বাংলাদেশে আছে, যাচাই বাছাই করে তাদের ফিরিয়ে নিতে তারা তৈরি আছে। কিন্তু জাতিসংঘ বলছে, মিয়ানমারে এখনও রোহিঙ্গাদের ফেরার মত অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আর রোহিঙ্গারা বলছে, নিরাপত্তার পাশাপাশি নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা পেলেই কেবল তারা ফিরে যাওয়ার কথা ভাববে।
নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে পশ্চিমা দেশগুলোর দিক থেকেও মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে একই ধরনের পর্যবেক্ষণ এসেছে।
জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত কারেন পিয়ার্স বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় তারা অত্যন্ত হতাশ।
‘শরণার্থীরা ফিরে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে এমন পরিবেশ অবশ্যই সেখানে নিশ্চিত করতে হবে।’
ফ্রান্সের প্রতিনিধি বলেন, এ পর্যন্ত মিয়ানমার সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিতান্তই অপ্রতুল।
জার্মানির প্রতিনিধি বলেন, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বস্তুত কোনো অগ্রগতিই হয়নি। লাখ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর বাংলাদেশে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় আরও এক, দুই বা তিন বছর কাটাতে বাধ্য হতে পারে। এ কথা ভাবলেও ভীতির সঞ্চার হয়।
মিয়ানমার প্রশ্নে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ক্রিস্টিন শ্রেনার বুরজেনে বলেছেন, লাখ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ অসম্ভব উদারতা দেখিয়েছে। কিন্তু অনির্দিষ্টকালের জন্য রোহিঙ্গারা সে দেশে অবস্থান করবে, এটা হতে পারে না। একা বাংলাদেশের পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তার আবেদন জানান।
তবে ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে দুই মিত্র দেশ চীন ও রাশিয়াকে বরাবরের মতই পাশে পাচ্ছে মিয়ানমার।
জাতিসংঘে চীনের উপ রাষ্ট্রদূত উ হাইতাও বলেন, এটা একেবারেই মিয়ানমার ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়। সুতরাং তাদেরকেই এর সমাধান খুঁজে বের করার সুযোগ দিতে হবে।
রাশিয়ার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে চীনা রাষ্ট্রদূত দাবি করেন, অবস্থার শুধু উন্নতি হয়েছে, তা–ই নয়, প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ফিরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে কোনো পূর্বশর্ত আরোপ সমস্যার সমাধানকে আরও প্রলম্বিত করবে। তিনি অবশ্য স্বীকার করেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নটি অনেক দিনের পুরোনো, তা সমাধানের জন্য মূল কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।
বৈঠকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত সংকট সমাধানে তার সরকারের অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি দাবি করেন, রাখাইন উপদেষ্টা বোর্ড সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যেসব সুপারিশ করেছে, তার সবগুলোই বাস্তবায়িত হচ্ছে। তার বিবেচনায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো প্রত্যাবাসন–প্রক্রিয়া শুরু করা।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত পরিষদকে জানান, তার সরকার এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ইতিমধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, উভয় পক্ষ যদি তা মেনে চলে, তাহলে প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা সম্পাদন সম্ভব হবে।
টাইমস/এসআই