পার্বত্য এলাকায় সহিংসতার শেষ কোথায়?

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক এলাকায় সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত ছয়জনের ময়নাতদন্ত খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বাঘাইছড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।

মঙ্গলবার দুপুরে বাঘাইছড়ি থেকে সড়কপথে পুলিশ ও বিজিবির পাহারায় ছয়টি মরদেহ খাগড়াছড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ময়নাতদন্ত শুরু হয়। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ময়নাতদন্ত শেষ হয়।

বাঘাইছড়ি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লাশগুলো বাঘাইছড়ি নিয়ে স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এ ছাড়া সোমবারের ঘটনার ব্যাপারে মামলার প্রস্তুতি চলছে। সন্ত্রাসীদের ধরতে সেনা, বিজিবি ও পুলিশের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চলছে।

মঙ্গলবার নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে কেন্দ্র থেকে ফলাফল ও সরঞ্জাম নিয়ে ফেরার পথে বাঘাইছড়ি-দীঘিনালা সড়কের ৯ মাইল এলাকায় দুর্বৃত্তদের ব্রাশফায়ারে ছয়জন নিহত এবং ২০ জনের বেশি আহত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার এবং মঙ্গলবার আরও দুজন মারা যান।

বেঁচে আসা এক শিক্ষকের মুখে বাঘাইছড়ির ব্রাশফায়ার

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ১৬ জেলার ১১৫ উপজেলায় সোমবার ভোট নেওয়া হয়। তারমধ্যে বাঘাইছড়ি উপজেলাও ছিল। তবে পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-জেএসএস সমর্থিত প্রার্থীরা কারচুপির অভিযোগ এনে সকালেই ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়। এরপর সন্ধ্যায় ঘটে ওই হত্যাকাণ্ড।

বাঘাইছড়ি উপজেলার মুসলিম ব্লক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইয়াসমিন আক্তার। পোলিং অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে ইয়াসমিনকে পাঠানো হয়েছিল বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। নিজে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারলেও চোখের সামনে সহকর্মীদের খুন হতে দেখার পর স্বাভাবিক হতে পারছেন না তিনি। তিনি জানালেন ঠিক কী ঘটেছিল সোমবার সন্ধ্যায়।

দুর্গম পাহাড়ে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রোববার দুপুরেই তারা কেন্দ্রে পোঁছে যান। সোমবার সকালে নির্ধারিত সময়েই ভোট শুরু হয়।

ইয়াসমিন আক্তার বলেন, ‘পুরোটা সময় বেশ ভালোভাবে সব হচ্ছিল। ভোটাররা এসে ভোট দিচ্ছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল ভোটগ্রহণ। কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হলো। এরপর আমরা গণনাও শেষ করলাম।’

ওই কেন্দ্রে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন জনসংহতি সমিতির এমএন লারমা অনুসারী অংশের প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা। তার প্রতীক ছিল ঘোড়া। সুদর্শনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা জনসংহতি সমিতির সন্তু লারমার অনুসারী অংশের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের গত মেয়াদের চেয়ারম্যান বড়ঋষি চাকমা ভোটের সকালেই জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। নির্বাচনে তার প্রতীক ছিল দোয়াত কলম।

ইয়াসমিন জানান, ফলাফল ঘোষণার পর ওই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা প্রায় ২৫ জন গাদাগাদি করে একটি চাঁদের গাড়িতে উঠে রওনা হন বাঘাইছড়ির উদ্দেশ্যে। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার ছাড়াও পুলিশ ও ভিডিপি সদস্যরা ছিলেন ওই গাড়িতে।

তাদের গাড়ি যখন বাঘাইহাট পৌঁছায়, তখন সেখানে অপেক্ষা করছিল আরও দুটো চাঁদের গাড়ি। সাজেক ইউনিয়নের কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট শেষে ভোটগ্রহণকর্মীরা ওই দুটি গাড়িতে করে তাদের সরঞ্জাম নিয়ে ফিরছিলেন।

ইয়াসমিন আক্তার  বলেন, ‘আমাদের তিনটি গাড়ি তখন একসঙ্গে বাঘাইছড়ির দিকে রওনা করল। আমাদের নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে ছিল বিজিবির একটা টহল গাড়ি। চারটি গাড়ির বহর, সবার সামনে বিজিবির গাড়ি। তার পেছনেই ছিল আমাদের গাড়িটা। গাড়িগুলো নয়মাইল এলাকায় পৌঁছানো মাত্র পাশের উঁচু পাহাড় থেকে পেছনের তিনটি গাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মত গুলি শুরু হয়। কিন্তু আমাদের গাড়িগুলো থামেনি। গুলি উপেক্ষা করে চালকরা গাড়ি টেনে চালিয়ে সরাসরি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসে। এ এক বিভৎস অভিজ্ঞতা। কান্না, চিৎকার, রক্ত...।’

‘সারা দিন আমরা একসাথে কাজ করলাম, সেই মানুষগুলো একের পর এক…,’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইয়াসমিন আক্তার।

রক্তাক্ত চাঁদের গাড়ি থেকে নামানোর পর একে একে ছয়জনের মৃত্যু হয়। রাতে চট্টগ্রামের হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান আরও একজন।

নিহতরা হলেন- পোলিং অফিসার আমির হোসেন ও আবু তৈয়ব, আনসার-ভিডিপি সদস্য মিহির দত্ত, আল আমিন, বিলকিস আক্তার ও জাহানারা বেগম এবং গাড়িচালক মন্টু চাকমা।

একটু সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ পরে তিনি বলেন, ‘এটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ভাই, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা। আমার সহকর্মী আমির হোসেন, তৈয়ব আলী মারা গেছেন। আমার বান্ধবী কাঞ্চি, বড় ভাই বদিউজ্জামান, ওরা গুরুতর আহত। হতাহত সবাইতো আমার কমবেশি চেনা। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কেন তাদের মরতে হলো?’

‘কবে বন্ধ হবে এসব বর্বরতা। আর কত লাশ পড়বে পাহাড়ে? এর মধ্যে কীভাবে আমরা সরকারি দায়িত্ব পালন করব?’

প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইয়াসমিন বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বাচন কিংবা যে কোনো সরকারি দায়িত্ব পালন করা সবসময়ই কঠিন। আমাদেরকে নানা ধরনের চাপে থাকতেই হয়। কিন্তু এরকম ভয়াবহ বর্বরতা ভবিষ্যতে আমাদের আরও বেশি চাপে ফেলবে। আমি অনুরোধ করি, আপনি আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।’

কেন অশান্ত পার্বত্য এলাকা?

পাহাড়ে সংঘাতে গত ১৫ মাসে ৫৮ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে পাহাড়ের দুই জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে আঞ্চলিক দলগুলো সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে। এসব হামলার ঘটনা মূলত তিনটি আঞ্চলিক দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এগুলো হচ্ছে ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক এবং জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)। এই তিনটি দলের মধ্যে এক পক্ষে ইউপিডিএফ এবং আরেক পক্ষে রয়েছে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ও জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)।

একবার এক বা দুই দলের কেউ আক্রান্ত হলে পরেরবার তাদের প্রতিপক্ষের কেউ হামলার শিকার হচ্ছে। তবে কোনো পক্ষই ঘটনার দায় স্বীকার করে না। পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় হতাহত হচ্ছে সাধারণ মানুষও। তবে এবার আঞ্চলিক দলগুলোর বাইরে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যবস্তুর শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ।

১৯৭২ সালে পাহাড়ের মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য জেএসএস গঠিত হয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি হওয়ার পর জেএসএসের বাইরে ইউপিডিএফ নামে নতুন দল গঠিত হয়। পরে ২০১০ সালে মূল জেএসএস ভেঙে গঠিত হয় জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)। ২০১৫ সালে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে খুনোখুনি প্রায় বন্ধ ছিল। তবে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফ ভেঙে আরও একটি নতুন দল গঠিত হয়।

ইউপিডিএফের সাবেক নেতা তপন জ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে নতুন সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে। নতুন এ সংগঠন আত্মপ্রকাশের পরই অশান্ত হয়ে ওঠে পাহাড়। সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের ২০ দিনের মাথায় ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটির নানিয়ারচরে সাবেক ইউপি সদস্য ও ইউপিডিএফ নেতা অনাদি রঞ্জন চাকমাকে ব্রাশফায়ারে খুন করে সন্ত্রাসীরা। এরপর থেকে শুরু হয় খুনোখুনি।

এর মধ্যে তিনটি বড় ঘটনা ঘটেছে গত ১০ মাসে। গত ৪ মে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক তপনজ্যোতি চাকমাসহ পাঁচজন খুন হন। আগের দিন খুন হয়েছিলেন রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা। তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পথে গুলিতে এই পাঁচজন খুন হন। গত ১৮ আগস্ট খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর বাজারে গুলিতে ছয়জন নিহত হন। সোমবার(১৮ মার্চ) খুন হলেন ছয়জন। এর মধ্যে একজন পোলিং কর্মকর্তা, চারজন আনসার সদস্য, একজন গাড়িচালকের সহকারী।

সহিংসতার শেষ কোথায়?

সাড়ে ১৫ মাস ধরে খুনোখুনির ঘটনা ঘটতে থাকলেও তা বন্ধে দলগুলোর মধ্যে বা প্রশাসনের মধ্যে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ইউপিডিএফ মনে করে, সংঘাত বন্ধের চাবি সরকারের হাতে। তবে প্রশাসন মনে করে, দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব বসলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

 

টাইমস/এসআই

 

Share this news on: