বুড়িগঙ্গার তীর দখল করে রেখেছে ৩৩ ডকইয়ার্ড!  

রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অন্তত তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে লঞ্চ-স্টিমার তৈরি ও মেরামতের জন্য  গড়ে উঠেছে ৩৩টি ডকইয়ার্ড।

নদীর তীর দখল করে গড়ে উঠা বেশিরভাগ জাহাজ নির্মাণ কারখানা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছ থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র নেয়নি।

অভিযোগ আছে, বিআইডব্লিউটিএর কিছু কর্মকর্তা প্রতিমাসে এসব ডকইয়ার্ড থেকে মাসোহারা নেন।  তবে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা এই অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন।

বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ডকইয়ার্ডগুলোর বেশিরভাগেরই কোনো অনুমোদন নেই। তাদেরকে এই জায়গা থেকে সরে যেতে  প্রায় প্রতিবছর একটা করে নোটিশ জারি করা হয়। কিন্তু ডকইয়ার্ড মালিকরা সেখান থেকে যান না।

পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি এসব ডকইয়ার্ডের কারণে দেশের প্রধান নদীবন্দর সদরঘাটের নৌপথ সংকুচিত হচ্ছে। সম্প্রতি দূষণ ও নৌপথ বাঁচাতে এ ডকইয়ার্ডগুলো স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

এ নিয়ে বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী ডকইয়ার্ড মালিকদের সংগঠন ঢাকা শিপ বিল্ডার্স গ্রুপের কার্যকরী সদস্য ও লঞ্চ মালিক সমিতির আহ্বায়ক প্রিন্স আওলাদ বাংলাদেশ টাইমস’কে বলেন, গত ১৯৬০ সাল থেকে আমরা এখানে জাহাজ ও লঞ্চ মেরামত করি। তবে কেউ নদী দখল করেননি। ডকইয়ার্ডগুলোর মালিকই অধিকাংশ জায়গার মালিক। এখানে প্রতি বছর প্রায় ৮০টি নতুন জাহাজ নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলরত প্রায় আটশত জাহাজ ও লঞ্চও এই ডকইয়ার্ডগুলোতে মেরামত করা হয়ে থাকে।

তিনি বলেন, আমরা পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাই না। আর এর সাথে সম্পৃক্ত আছে প্রায় ৩ থেকে ৪ লাখ লোক। যদি এটি অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা হয় তবে এখানকার শ্রমিকদের চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করা ছাড়া ‍উপায় থাকবে না। তাই আমাদেরকে আরো পাঁচ বছর থাকার জন্য অনুমতি দেওয়া হোক।

তবে এ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বিআইডব্লিউটিএর বন্দর ও পরিবহন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন বাংলাদেশ টাইমস’কে বলেন, ডকইয়ার্ডের মালিকদের এই যুক্তিটা ঠিক হবে না। স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট ১৯৫০ অনুযায়ী, বালুচরের জমি বন্দোবস্তযোগ্য নয়। তারা পরিবেশের ক্ষতি তো করছেই, পাশাপাশি পানিপ্রবাহের ক্ষতি হচ্ছে। নদীপথ সংকুচিত হয়ে গেছে। নদী হত্যা করে কোনো ব্যবসা চলতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, আমরা বার বার তাদের কথা মতো সুযোগ দিয়েছি। গত বছর তাদের ওখান থেকে দুইটি ডকইয়ার্ডকে ভেঙে দিয়েছিলাম। তাই তারা সবাই মিলে আমাদের নামে একটি মামলা করে। আর হাইকোর্ট থেকে তাদের পক্ষে মামলার ফলাফল আনে। তখন আমরা সেই মামলাটি আপিল বিভাগে আপিল করে আমাদের পক্ষে মামলার রায় পাই।

আরিফ উদ্দিন আরও বলেন, আমরা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের তেলঘাট থেকে কোল্ড স্টোরেজ পর্যন্ত রাস্তা বানানোর কাজ অতি তাড়াতাড়িই শুরু করবো। আর আমরা তো মামলার রায় পেয়ে গেছি। তবে প্রধানমন্ত্রী, নৌ মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ, পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ একাধিক কর্তা ব্যক্তিদের নির্দেশ আছে যে, এই ডকইয়ার্ডটি স্থানান্তর করে গজারিয়াতে নিয়ে যাওয়ার। তবে তা নিয়মতান্তিকভাবে সরানোর কাজ চলবে। আর ডকইয়ার্ড মালিকরা তো সরকারের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। তাদের দিক বিবেচনায় আমরা তাদেরকে সুযোগ দিয়েছি।

এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মজিবুর  রহমান হাওলাদার বাংলাদেশ টাইমস’কে বলেন, ৩৩টি ডকইয়ার্ডের মধ্যে ৩০টির কোনো নামজারি পাওয়া যায়নি। শুধু দুটি ডকইয়ার্ডের শুধুমাত্র দলিল আছে।

অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীর ভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০১০-এ বলা হয়েছে, জলপথ ও তীর ভূমিতে স্থাপনার জন্য সংশ্লিষ্ট নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি বা ছাড়পত্র নিতে হবে। কিন্তু এ অনুমোদন ছাড়াই চলছে ডকইয়ার্ডগুলো।

সরেজমিনে বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী চর কালিগঞ্জ ও চর মীরেরবাগে ঘুরে দেখা গেছে, নদী তীরের ডকইয়ার্ডগুলোতে চলছে নতুন জাহাজ ও লঞ্চ তৈরির কাজ। পাশাপাশি নদীতে নোঙর করে চলছে পুরনো জাহাজ মেরামতের কাজও। বিভিন্ন ইয়ার্ড থেকে জাহাজ তৈরি ও ভাঙার বিভিন্ন অংশও নদীতেই ফেলা হচ্ছে। কারখানাগুলোতে কাজ করছে প্রায় ১০ হাজারের মতো মানুষ। নানা বয়সী মানুষ তাদের কারোই নেই সুরক্ষা সরঞ্জাম। এ ছাড়া মেরামতের সময় পুরনো জাহাজে থাকা ডিজেল, লুব্রিক্যান্টসহ তলদেশে থাকা বিভিন্ন বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশে যাচ্ছে।

আসাদুল হক নামের এক কর্মচারী বলেন, আমাদের যেখানেই স্থানান্তর করা হবে আমরা সেখানেই যাবো। তবে আমাদের চুরি ও ডাকাতির প্রশ্নই উঠে না। আমরা সরকারের সাথে একমত। আসলে এখানে এই শিল্প গড়ে উঠতে পারে না। আর এখানে প্রতিদিনই ১০ হাজারের মতো কর্মচারী কাজ করে। আর আমাদের বেতন তো রোজ ভিত্তিক, চুক্তিভিত্তিক নয়।

তবে বিআইডব্লিউটিএ'র বন্দর ও পরিবহন বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ জাহিদ মিজানুর রহমান বলেন, ধলেশ্বরী, তুরাগ, বালু আর বুড়িগঙ্গা নদীতে আমাদের ১২০ কিলোমিটার জায়গা আছে। আমরা সেসব জায়গাটি দখল মুক্ত করবো। এখন আমরা প্রায় ২০ কিলোমিটার দখল মুক্ত করেছি। আর ৫২ কিলোমিটারের উপরে ইকোপার্ক, খেলার মাঠ সহ নানা কিছু হবে বলেও উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি।

পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুযায়ী, পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জাহাজ নির্মাণ শিল্প ‘লাল’ শ্রেণিভুক্ত। নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পালন সাপেক্ষেই অনুমোদন মেলে এ শিল্পের। ডকইয়ার্ড পরিচালনার ক্ষেত্রেও রয়েছে কিছু শর্ত। যেমন একটি ডকইয়ার্ডে অবশ্যই একজন নেভাল আর্কিটেক্ট থাকতে হবে। তিনি জাহাজের নকশা করবেন এবং সে অনুযায়ী সেটি নির্মিত হচ্ছে কি না তা তদারকি করবেন।

সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কর্তারা জানিয়েছেন, ডকইয়ার্ডগুলোতে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর অনুমোদিত নির্দিষ্টসংখ্যক ওয়েল্ডার, প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী, শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতের নানা উপকরণ রাখার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।

বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌযান চলাচল নিরাপদ ও নিশ্চিত করতে সদরঘাট টার্মিনালের বিপরীত পাড়ের সব ডকইয়ার্ড অন্যত্র স্থানান্তরের বিষয়ে গত এপ্রিল মাসে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেছেন।

এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান বলেন, জাহাজ নির্মাণ শিল্প আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে চাই না। তবে নদী রক্ষা করতে চাই।

তবে ঢাকা শিপ বিল্ডার্স গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ও শুভাদোয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে তার চাচাতো ভাই উজ্জ্বল বলেন, এটি স্থানান্তর করলে আমাদের অনেক অসুবিধা হবে।

 

টাইমস/টিআর/জেডটি

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জুনের মধ্যেই ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী Mar 29, 2024
img
বাজারে বেড়েছে মাংসের দাম, সবজিতে স্বস্তি Mar 29, 2024
img
বিএনপির ৮০ ভাগ নিগৃহীত নেতাদের তালিকা দিতে হবে : ওবায়দুল কাদের Mar 29, 2024
img
জায়েদ খানের নায়িকা হচ্ছেন টালিউডের পূজা ব্যানার্জি Mar 29, 2024
img
বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর পৌনে ৪ কিলোমিটার দৃশ্যমান Mar 29, 2024
img
আজ ঢাকার বাতাস ‘অস্বাস্থ্যকর’ Mar 29, 2024
img
দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫ Mar 29, 2024
img
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামে সর্বোচ্চ রেকর্ড Mar 28, 2024
img
দূষণের কারণে বছরে পৌনে ৩ লাখ বাংলাদেশির মৃত্যু Mar 28, 2024
img
আইএমএফের হিসাবে দেশের রিজার্ভ এখন কত, জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক Mar 28, 2024