‘বঙ্গবন্ধু-পাগল’ কাঠমিস্ত্রি নাসিরের গল্প

মো. নাছির। পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। ভারতের হাওড়ায় টানা ২২ বছর এক ওস্তাদের কাছে কাজ শিখেছেন। দেশে ফিরে শুরুতে কাঠের কাজ করলেও পরবর্তীতে ভাস্কর্য তৈরির প্রতি মনোযোগী হন। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরির প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল।

দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ভাস্কর্য তৈরি করেছেন নাসির। ভাস্কর্যটি তিনি এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিতে চান।

শুধু তাই নয়, কাঠ দিয়ে একে একে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের ভাস্কর্য নির্মাণ করতে চান তিনি।

কাঠমিস্ত্রি নাছির বাংলাদেশ টাইমসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, বাবা ও দাদা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ছোট বেলা থেকে বাবার মুখে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের কথা শুনি।

তিনি বলেন, প্রত্যেক বাবা তার সন্তানকে লেখাপড়া করান। কিন্তু আমার বাবা একটু ব্যতিক্রমী। তিনি কষ্ট করে আমাকে কাঠের কাজ শিখিয়েছেন। তিনি অনেক কষ্ট করে ভারতের হাওড়ায় প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা পাঠিয়ে এক মিস্ত্রির কাছে আমাকে সেই সময়ে কাঠের কাজ করা শিখিয়েছেন। আর আমি ২২ বছর ধরে এই কাজ শিখেছি।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরিতে বাবার আদেশ পালন করতে গিয়ে তিনি অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বলেও জানান নাসির।

তবুও বাবার আদেশের পিছপা হইনি বলে জানান তিনি। তাই তিনি এই ভাস্কর্যগুলো একটু একটু করে তৈরি করেছেন।

নাসির ভারতের সেই ওস্তাদের কাছে টানা ২২ বছর থাকেন। সেখান থেকে ১৯৮০ সালের দিকে তিনি নিজ গ্রাম কক্সবাজারের চকোরিয়া থানার নোয়াপাড়ায় চলে আসেন।

তবে তিনি সেখানে কাঠের কাজ না করে ১৯৮৮ সাল থেকে কক্সবাজারের টেকনাফে গিয়ে কাঠের কাজ শুরু করেন। কয়েক বছর কাজ করার পরে তিনি ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুর অবয়বে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন।

যখন তিনি কাঠ দিয়ে মুখোশ আকৃতি বানান। তখনই স্থানীয় বিএনপির ক্যাডার সাব্বিরের লোকজন তার সাথে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার শুরু করেন।

পরে তারা ১৯৯৮ সালে তাকে হত্যা করবে বলে আটকিয়ে রাখে। পরের দিন তারা আমাকে ট্রলারে উঠিয়ে নিয়ে হত্যা করবে বলেও জানায়। তারপরে তিনি ভয়ে স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে রেখে ঢাকায় চলে আসেন। তারপরে তিনি খুলনায় চলে যান।

নাছির বলেন, আমার নাম কিন্তু নাছির নয়। আমার আসল নাম হচ্ছে বেলাল। শুধু বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ভাস্কর্য তৈরি করেছি বলে বিএনপির নেতাকর্মীদের ভয়ে আসল নাম পরিবর্তন করেছি। খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলার আওয়ামী লীগের নেতা জিলাম তালুকদারের আশ্রয়ে উঠে কাঠের ব্যবসা শুরু করি। তিনি আমাকে ফার্নিচারের ব্যবসার জন্য একটি ঘর দেন। তখনই আমি ২০০০ সালে দ্বিতীয় বিয়ে করি। আর আমরা স্বামী-স্ত্রী দুইজন মিলে কাঠ দিয়ে ফার্নিচার বানানো শুরু করি। ঠিক তখনই আমি একটি মুখোশ ছাড়া একটি ভাস্কর্য তৈরি করি।

তিনি আরও বলেন, ২০০৫ সালের দিকে আমি যখনই বঙ্গবন্ধুর মুখোশ পড়াই, ঠিক সেই সময়ে সেখানকার সংসদ সদস্য বিএনপির সেলিম ভাইয়ের অনুসারী দুলাল নেতার কিছু নেতাকর্মী আমার বাড়িতে এসে পিস্তল ধরে ও শারীরিক অত্যাচার শুরু করে। তারা প্রথমে আমাকে অফার করে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ভাস্কর্য তৈরি করতে। কিন্তু আমি রাজি হইনি। তখনই তারা আমার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপরে অনেক কাঠ ও ফার্নিচারও নিয়ে যায়। তখনই আমরা ভয়ে ২০০৭ সালে সেখান থেকে স্ত্রী ও বাচ্চাকে নিয়ে রাঙ্গামাটিতে গিয়ে উঠি।

নাছিরের দ্বিতীয় স্ত্রী মাসুদা বেগম বলেন, ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আমার স্বামী পাগল অবস্থায় ছিল। ২০১০ সালের দিকে আমরা পুরান ঢাকার সূত্রাপুর থানার সামনে উল্টিলগঞ্জ মহল্লায় উঠি। আমি ও আমার স্বামী অনেক কষ্ট করে সংসার চালাই। এখন এই এলাকায় এসে আমরা খুব সুন্দর করে ভাস্কর্য তৈরি করে যাচ্ছি। তবে একটু সময় লাগছে। কিন্তু এর মধ্যে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এসে বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি নিয়ে গেছে। সেই ছবিটি আমরা বিনা মূল্যে দিয়ে দিয়েছি।

নাছির বলেন, আমার প্রথম বউও জানতো, আমি মারা গিয়েছি। তবে বাবার আদেশ মোতাবেক আজও আমি বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে কাঠ দিয়ে সুন্দর ফ্রেমে তৈরি করি।

এই কাঠশিল্পী আরো বলেন, বাবা ও দাদা দুইজনই মুক্তিযোদ্ধা। আর বাবা সব সময় বঙ্গবন্ধুর নাম বলতেন। আর তার কথা মতো আমি আজও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবারই ছবি এই কাঠ দিয়ে তৈরি করবো।

‘প্রথমে শেখ রাসেল, তারপরে তার ভাইদের ছবিও কাঠের মধ্যে তুলে ধরবো। আর বঙ্গবন্ধু যেভাবে হত্যা হন মানে তিনি যে সিঁড়ি দিয়ে নিচে পড়ছেন তাও আমার পরিকল্পনা আছে সেটি বানাবো’ যোগ করেন নাসির।

 

টাইমস/টিআর/জেডটি

Share this news on:

সর্বশেষ

img
গ্রেপ্তারি পরোয়ানার শঙ্কায় নেতানিয়াহু, ইসরায়েলে জরুরি বৈঠক Apr 19, 2024
img
পালিয়ে বাংলাদেশে এলেন আরও ১১ বিজিপি সদস্য Apr 19, 2024
img
কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন শেখ হাসিনা Apr 19, 2024
img
প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন : অর্থমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে গেল বাস, প্রাণ গেল প্রকৌশলীর Apr 19, 2024
img
চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি Apr 19, 2024
img
৩টি ড্রোন ধ্বংস করল ইরান, ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনা নিরাপদ Apr 19, 2024
img
সবজির বাজার চড়া, কমেনি মুরগির দাম Apr 19, 2024
img
‘যারা নুন-ভাতের চিন্তা করতে পারত না তারা মাছ-মাংসের চিন্তা করে’ Apr 19, 2024
img
ইরানে ইসরায়েলি হামলা, লাফিয়ে বাড়ল তেল ও স্বর্ণের দাম Apr 19, 2024