শিশুদের হাতে স্মার্টফোন, আনস্মার্ট সিদ্ধান্ত

বড়দের উদাসীনতা বা নেকামির কারণে ছোটো বাচ্চারা মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে; যার প্রভাব ও কুফল খুবই ভয়ংকর। শিশুরা ফোন চাইলেই দিতে হবে এটা নিশ্চয়ই স্মার্টনেস নয়। আমরা বড়রা যেভাবে ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছি, আগামীতে শিশুরাও আরো বেশি আসক্ত হয়ে পড়ছে। বাবা-মা কর্ম ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে সময় না দেওয়ার কারণে অথবা শখ করে ফোন কিনে দেওয়াই বা তাদের বায়না পূরণ করতে মোবাইল উপহার দেওয়া ইত্যাদি কারণে আদরের শিশুদের হাতে হাতে ফোন। বাচ্চারা ইচ্ছেমতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেইম খেলছে, ভিডিও দেখছে, ফোন নিয়ে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে। কমবয়সী শিশুদের হাতে ফোন দিয়ে আমরা যে বিপদ ডেকে আনছি; সেটা আজ জরুরি সমাধানের সময় এসেছে।

সম্প্রতি সু্ইডেনের একটি গবেষণা থেকে বেড়িয়ে এসেছে যে, তরুণেরা যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এবং যাদের বয়স ২০ বছরের কম, অন্যদের তুলনায় তাদের প্রায় ৫ গুন বেশি সম্ভাবনা থাকে ব্রেন ক্যানসারের। অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, একটি দুই মিনিট স্থায়ী মোবাইল কল শিশুদের মস্তিষ্কের হাইপার এ্যাক্টিভিটি সৃষ্টি করে যা কিনা পরবর্তী এক ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের মস্তিষ্কে বিরাজ করে। ইউরোপিয়ান জার্নাল অব অনকোলজির এক রিপোর্টে কর্ডলেস ফোন ব্যবহারের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কর্ডলেস ফোন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রেডিয়েশন ছড়ায় যার ফলে ব্যবহারকারীর হার্ট এ্যাটাক্ট এর সম্ভাবনা বেড়ে যায় দ্বিগুণ, ব্যবহারকারীর স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, রক্তের চাপ বেড়ে যায়, দেহ ধীরে ধীরে ক্লান্ত এবং নিস্তেজ হয়ে পড়ে এমনকি নিয়মিত ঘুমেও ব্যাঘাত ঘটায়। শিশুদের জন্য যে কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। রেডিয়েশন প্রাপ্ত বয়স্কদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, শিশুদের জন্য তা আরো বেশি মারাত্মক ক্ষতিকর যা কিনা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশকে ব্যাহত করে। সারা পৃথিবীতেই এখন শিশুরা প্রায় বেশিরভাগ সময়েই মোবাইল ফোন নিয়ে খেলা করে থাকে। এ প্রসঙ্গে সানি’স স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর ডিন ডেভিড কার্পেন্টার বলেছেন যে, ‘শীঘ্রই আমরা হয়তো একটি মহামারী রোগের শিকার হতে পারি এবং সেটি হবে মস্তিষ্কের ক্যানসার।’ গবেষণা থেকে আরো বেড়িয়ে এসেছে যে মোবাইল ফোন ব্যবহার শিশুদের শ্রবণ ক্ষমতাও হ্রাস করে দেয়। রেডিয়েশন গবেষক কেরি ক্রফটন বলেছেন যে, ‘তবে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই এখন ১৮ বছরের কম বয়সীদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, যা কিনা অন্যদের জন্য একটি ভালো নিদর্শন।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাঈদা আনোয়ার পপি বলেন, মোবাইলের প্রতি আসক্তি শিশুদের সামাজিক দক্ষতা নষ্ট করছে। ফলে তৈরি হয় শিশুদের নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। এ ছাড়া প্রযুক্তির এ আসক্তির ফলে শিশুদের আবার দীর্ঘসময় বসে থাকতে হচ্ছে; ফলে শিশুর স্থূলতাও বেড়ে যাচ্ছে। জীবনে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবও ফেলছে এই ফোন। অন্যদিকে দীর্ঘসময় মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখার ফলে শিশুর চোখের সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। শিশুদের পারিবারিক ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।

যাহোক অতি স্মার্ট বানাতে গিয়ে আদরের সোনামণিদের জীবন ও ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দিকে ধাবিত করা কোনভাবেই কাম্য নয়। বিভিন্ন মেডিসিনের কভারে যেমন লেখা থাকে 'শিশুদের নাগালের বাহিরে রাখুন'; ঠিক একইভাবে অভিভাবকদের মনে লিখে রাখতে হবে 'শিশুদের ফোন থেকে দূরে রাখুন।' কিভাবে মোবাইল ফোন থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখা যাবে সেই পথ নিশ্চয়ই সবার জানা আছে। মনে রাখতে হবে স্মার্টফোন থাকলেই স্মার্ট হয় না, প্রযুক্তির অভিশাপ থেকে নিজে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখাই হলো প্রকৃত স্মার্ট।

 

লেখক:

শফিকুল ইসলাম,

বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা), প্রভাষক (হিসাববিজ্ঞান),

মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ

Share this news on: