প্রাসাদটির ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, তৎকালীন মুক্তাগাছা জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী। তার তৃতীয় উত্তরাধিকারী রঘুনন্দন আচার্য চৌধুরী ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক নিলেন । মৃত্যুর আগে দত্তক পুত্রের হাতে জমিদারির ভার অর্পণ করেন রঘুনন্দন। জমিদার গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীও ছিলেন সন্তানহীন। গৌরীকান্তের মৃত্যু হলে তার বিধবা পত্নী বিমলা দেবী দত্তক নিলেন কাশীকান্তকে। কাশীকান্তও একই অবস্থায় মারা যান। তার বিধবা পত্নী লক্ষ্মী দেবী আচার্য চৌধুরানী দত্তক নিলেন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে। ভাগ্যের পরিহাসে তিনিও ছিলেন নিঃসন্তান। তিনিও শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী নামে একজনকে দত্তক নেন।
সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী তার শাসনামলে ময়মনসিংহ শহরে স্থাপন করেন নান্দনিক কিছু স্থাপনা। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে তিনি ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে ৯ একর জমির উপর নির্মাণ করেন দৃষ্টিনন্দন একটি বাড়ি। দত্তক পুত্রের নামানুসারে এর নাম দেন শশীলজ। বাড়িটি দ্বিতলবিশিষ্ট।
১৮৯৭ সালের প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয় এই অঞ্চলে। এতে প্রসাদটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে ১৯০৫ সালে পরবর্তী জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী পুনরায় আরও নান্দনিকভাবে ভবনটি নির্মাণ করে। এতে প্রাসাদটি আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।
প্রসাদটির মূল ফটকে রয়েছে ১৬টি গম্বুজ। ভেতরে প্রায় প্রতিটি ঘরেই রয়েছে ঝুলন্ত ঝাড়বাতি। বাসভবন ছাড়াও বাড়িটিতে রয়েছে স্নানঘর, নাচঘর। স্নানঘরে সাথে আছে একটি সুড়ঙ্গ। যা দিয়ে মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল বলে ধারণা করা হয়। মূল ভবনের পেছন রয়েছে দোতলা একটি স্নানঘর। পাশেই এটি পুকুর। পুকুরটির ঘাট মার্বেল পাথরে বাঁধানো।
এছাড়া শশীলজের মূল ভবনের সামনে রয়েছে বাগান। সেই বাগানের মাঝখানে আছে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা, যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গ্রিক দেবী ভেনাসের স্বল্পবসনা স্নানরতা মর্মর মূর্তি। বাগানের ঠিক পেছনেই লালচে ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত শশী লজ। তার পাশেই পদ্মবাগান। শশী লজের অন্দরে বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গালয়। সুদৃশ্য সেই রঙ্গালয়ের এক প্রান্তে বিশ্রামঘর। বিশ্রামঘরের পর কাঠের মেঝেযুক্ত হলঘর। হলঘরের পাশেই বর্ণিল মার্বেল পাথরে নির্মিত আরেকটি জলফোয়ারা। জলফোয়ারার ঠিক ওপরের ছাদ থেকে নিচে ঝুলানো স্ফটিকস্বচ্ছ কাচের ঝাড়বাতি। ভবনটির পেছনে একচিলতে উঠান। সবুজ ঘাসের আঁচল পাতা সেই উঠান পেরোলে একটি অপরিসর জলাশয়। প্রাসাদের আশেপাশে রয়েছে বেশকিছু দুষ্প্রাপ্য ও প্রাচীন গাছগাছালি; আছে দুষ্প্রাপ্য নাগলিঙ্গম, যা তখন হাতির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯৫২ সাল থেকে শশীলজ ব্যবহৃত হচ্ছে মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে। তখন থেকে এর মূল ভবনটি অধ্যক্ষের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জাদুঘর স্থাপনের জন্য ২০১৫ সালে বাড়িটি অধিগ্রহণ করে। প্রতিদিনই অসংখ্য দর্শনার্থীর আগমন ঘটে এখানে।
এই শশীলজেই হুমায়ূন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত বিখ্যাত ধারাবাহিক নাটক অয়োময়- এর পর্বগুলো ধারণ করা হয়েছিল। এছাড়াও রাখাল বন্ধু নামে ধারাবাহিক নাটকের শুটিংও হয়েছিল এখানে।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সড়ক পথে ময়মনসিংহে আসতে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে এনা, শামীম এন্টারপ্রাইজ, সৌখিনসহ কয়েকটি পরিবহন বাস রয়েছে। সময় নিবে আড়াই থেকে চার ঘণ্টা । এছাড়াও কমলাপুর, বিআরটিসি টার্মিনাল থেকে ঢাকা-নেত্রকোনা রুটের গাড়িতেও ময়মনসিংহে যেতে পারবেন। এনা ট্রান্সপোর্টে ভাড়া জনপ্রতি ২২০ টাকা। তাছাড়া সৌখিন পরিবহন-১৫০ টাকা। মাসাকান্দা বাসস্ট্যান্ডে নেমে অটোতে বা রিকশায় চলে যেতে পারবেন শশীলজ।
এছাড়া ঢাকা থেকে ট্রেনে করেও যেতে পারেন। ঢাকা থেকে তিস্তা এক্সপ্রেস (সকাল সাতটা বিশ), মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস (দুপুর দুইটা বিশ), যমুনা এক্সপ্রেস (বিকাল চারটা চল্লিশ), অগ্নিবীনা এক্সপ্রেস (সন্ধ্যা ছয়টা), হাওড় এক্সপ্রেস (রাত এগারোটা পনেরো) এ ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে ছাড়ে। ভাড়া শ্রেণিভেদে ১০০ থেকে ৩৬০ টাকা। সেখান থেকে অটোতে বা রিকশায় শশীলজ।
কোথায় থাকবেন: ময়মনসিংহে থাকার জন্য রয়েছে বেশ কিছু হোটেল। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আমির ইন্টান্যাশনাল (০১৭১১১৬৭ ৯৪৮), হোটেল মুস্তাফিজ ইন্টারন্যাশলনাল (০১৭১৫১৩৩ ৫০৭), হোটেল হেরা (০১৭১১১৬৭ ৮৮০), হোটেল সিলভার ক্যাসেল (০৯১৬৬১৫০, ০১৭১০৮৫৭ ০৫৪), হোটেল খাঁন ইন্টারন্যাশনাল (০৯১৬৫৯৯৫)।
খাওয়া দাওয়া: শহরের কেন্দ্রস্থলের প্রেসক্লাব ক্যান্টিনের মোরগ পোলাওয়ের আছে বেশ সুনাম। হোটেল সারিন্দা ও হোটেল ধানসিঁড়িও ভালো । এছাড়াও রয়েছে মাঝারি ও নিম্নমানের বেশ কিছু হোটেল।
টাইমস/এইচইউ