টিপু সুলতান: ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পথিকৃৎ

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়। ইংরেজরা কেবল বাংলা দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি। দখলদার এই সাম্রাজ্যবাদীরা পুরো ভারতবর্ষ দখল করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আর তাদের সেই স্বপ্নের পথে যিনি সবচেয়ে বড় কাটা হয়ে ছিলেন, তিনি হলেন মহীশুরের শাসনকর্তা টিপু সুলতান।

ইংরেজদের কাছে টিপু সুলতান ছিলেন একটি আতঙ্কের নাম। কারণ তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন। তিনি ছিলেন এমন একজন বীর যোদ্ধা, যিনি শৌর্যবীর্যের কারণে ভারতবর্ষে ‘শের-ই-মহীশুর’ (মহীশুরের বাঘ) নামে পরিচিত ছিলেন। তাকে বলা হয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীরপুত্র।

১৭৫০ সালের ২০ নভেম্বর ভারতের বর্তমান বেঙ্গালুর শহর থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে দেভানাহালি এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হায়দার আলী ছিলেন মহীশুরের সেনাপতি। যিনি পরে ১৭৬১ সালে মহীশুরের কার্যত শাসনকর্তার দায়িত্ব নেন।

টিপু নামে এক ফকিরের দোয়ায় এক পুত্র সন্তান লাভ করেন বাবা হায়দার। তাই তার নাম অনুসারেই ছেলের নাম রাখেন টিপু সুলতান। মহীশুরের স্থানীয় কানাড়ি ভাষায় ‘টিপু’ অর্থ বাঘ। আর সাহসিকতায় টিপু সুলতান আসলেই একজন বাঘ ছিলেন।

বাবা হায়দার আলী খুব একটা শিক্ষিত ছিলেন না। তাই তার স্বপ্ন ছিল ছেলে টিপু সুলতানকে শিক্ষা-দীক্ষায় দীক্ষিত করবেন। তাই ছেলেকে উর্দু, ফার্সি, আরবি, ইসলামি জ্ঞান ও যুদ্ধ-প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য তিনি শিক্ষক রেখেছিলেন। রণকৌশল ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে তার জন্য ফরাসি সামরিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।

১৭৬৬ সালে পিতার সঙ্গে প্রথম মহীশুরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৭ বছর বয়স থেকে বাবার গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক ও সামরিক মিশনের দায়িত্ব পালন করেন টিপু সুলতান। তিনি ছিলেন বাবা হায়দার আলীর ডান হাত। তার বীরত্বেই তার বাবা দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী শাসনকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

১৭৭৯ সালে টিপু সুলতানের অধীনে থাকা একটি ফরাসি-নিয়ন্ত্রিত দুর্গ দখল করে নেয় ইংরেজরা। সেই থেকে ইংরেজদের সঙ্গে তার চরম শত্রুতা তৈরি হয়। অসুস্থতার কারণে বাবা হায়দার আলী মারা গেলে ১৭৮২ সালের ২২ ডিসেম্বর মহীশুরের শাসনকর্তার দায়িত্ব নেন টিপু সুলতান।

শাসনভার নেয়ার পরপরই তিনি মারাঠা ও মোঘলদের সঙ্গে জোট গঠন করে ব্রিটিশ আগ্রাসন প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। ১৭৮৪ সালে ইংরেজদের সঙ্গে এক চুক্তির মাধ্যমে দ্বিতীয় মহীশুরের যুদ্ধের ইতি টানতে তিনি সক্ষম হন।

এরপর তিনি বাবার অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে মনোযোগ দেন। তিনি অসংখ্য রাস্তা, ঘাট, সেতু ও সরকারি স্থাপনা নির্মাণ করেন। বিশেষ করে সামরিক শক্তি বাড়াতে তিনি গভীর মনোযোগ দেন। এমনকি তিনি লোহার তৈরি এক ধরণের আধুনিক রকেট উদ্ভাবন করেছিলেন, যা ইংরেজদের হাতে থাকা সামরিক সরঞ্জাম থেকেও অনেক উন্নত ছিল। এই রকেট তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যবহার করছিলেন।

তিনি ১৭৮৯ সালে ইংরেজদের মিত্র বলে পরিচিত থিরুভিথামকুর রাজ্য আক্রমণ করলে তৃতীয় মহীশুরের যুদ্ধ লেগে যায়। কিন্তু ইংরেজরা হায়দ্রাবাদের রাজা, থিরুভিথামকুরের রাজা ও মারাঠাদের সঙ্গে জোট গঠন করে। লর্ড কর্নওয়ালিসের নেতৃত্বে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হলে অধীনস্থ বেশ কিছু এলাকা টিপু সুলতানের হাতছাড়া হয়ে যায়।

অনেকগুলো এলাকা হারানোর পরও হাল ছেড়ে দেননি এই বীর যোদ্ধা। আবারও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিলেন। ১৭৯৯ সালে মারাঠা, হায়দ্রাবাদের রাজা ও ইংরেজদের জোটের বিরুদ্ধে ‘চতুর্থ মহীশুরের যুদ্ধ’ শুরু হয়। এ যুদ্ধে ইংরেজদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৫০হাজারেরও বেশি। অন্যদিকে টিপু সুলতানের সৈন্য সংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজার। লর্ড ওয়েলেসলির নেতৃত্বে এ যুদ্ধে নিহত হন টিপু সুলতান। তার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে পুরো ভারতবর্ষ ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

কারণ ব্রিটিশদের আতংক ছিল যে ফরাসি সেনাপতি নেপোলিয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়ে টিপু সুলতান ভারতবর্ষ বৃটিশমুক্ত করে ফেলবেন। আর ফরাসি সম্রাটের কাছে চিঠি পাঠিয়ে সেই সহযোগিতাও চেয়েছিলেন তিনি। ভারতে থাকা ফরাসিরা টিপু সুলতানকে সামরিক সহায়তাও করেছিল।

কিন্তু সেদিন মীরজাফর আর ঘষেটি বেগমদের উত্তরসূরি মীর সাদিক (টিপুর এক সেনাপতি) বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলায়, যা টিপু সুলতানের পরাজয়কে অনিবার্য করে তুলে। অন্যথায় সেদিনের পর ভারতবর্ষের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে রচিত হত, যেখানে ব্রিটিশদের কোনো অস্তিত্বই থাকত না।

এদিকে টিপু সুলতানের মৃত্যুর দুইশ বছর পরও অনেকে তাকে সাম্প্রদায়িক বলে সমালোচনা করেন। কিছু কিছু সমালোচক তাকে কেবল একজন বর্বর ও খুনি বলে মনে করেন। তাদের দাবি টিপু জোরপূর্বক ভিন্ন মতাবলম্বীদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। তবে মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক শ্রীকান্তিয়া এসব তথ্যকে মিথ্যা অপপ্রচার বলে মন্তব্য করেন।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় টিপু সুলতানের শাসনব্যবস্থা সহনশীল ছিল। তিনি ১৫৬টি হিন্দু মন্দিরে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ দিতেন। এমনি একটি বিখ্যাত মন্দির হলো শ্রীরাঙ্গাপাটনার রঙ্গন অষ্টমী মন্দির। তাছাড়া কোষাধ্যক্ষ, ডাক ও পুলিশ বিভাগের প্রধানসহ অনেক কর্মকর্তাই ছিলেন হিন্দু।

টিপু সুলতান ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক বীর যোদ্ধা। ইংরেজদের কাছে যিনি ছিলেন একটি বিভীষিকার নাম। ইংরেজদের সাম্রাজ্য-বিস্তারে তিনি কত বড় বাঁধা ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার মৃত্যুর পরবর্তী ইতিহাসে। কারণ তার মৃত্যুতে খোদ ব্রিটেনের মাটিতে আনন্দ উৎসব হয়েছিল।

শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায়, টিপুর মৃত্যু সংবাদ শুনে লর্ড ওয়েলেসলির মন্তব্য ছিল এরকম- “ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, ভারতবর্ষের মৃত আত্মাকে স্মরণ করে আমি পান করছি”। এমনকি ওয়েলেসলি এটাও বলেছিলেন যে, “গোটা ভারতবর্ষই এখন আমাদের”।

আর ইংরেজদের এমন মন্তব্যই প্রমাণ করে টিপু সুলতান ভারতকে সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র থাবা থেকে মুক্ত রাখতে সর্বাত্মক সংগ্রাম গড়ে তুলছিলেন। তার এই সংগ্রাম ও ত্যাগ ছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার এক অন্যতম প্রেরণার উৎস।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img

ই-নথি সিস্টেম চালু

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফাইল চালাচালি এখন অনলাইনে Dec 09, 2025
img
ক্ষমতায় গেলে ৩ শর্তে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে: জামায়াত আমির Dec 09, 2025
img
এমএলএস কাপ জিতে বড় অর্থপুরস্কার পেলেন মেসিরা Dec 09, 2025
img
চলতি বছর ৮৫ হাজার ভিসা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র Dec 09, 2025
img
সময় নষ্ট না করে নেতাকর্মীদের মাঠে নামার আহ্বান তারেক রহমানের Dec 09, 2025
img
পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, বোনদের সাথে দ্বন্দ্বে ডিপজল! Dec 09, 2025
img
বিজয়ের মাসেই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান : আতিকুর রহমান রুমন Dec 09, 2025
img
ইউরো ফাইটার টাইফুন নিয়ে বিমান বাহিনীর এলওআই স্বাক্ষরিত Dec 09, 2025
img
নির্বাচনের আগে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে পুঁজিবাজার Dec 09, 2025
img

বিএনপি প্রার্থী শহিদুল আলম

‘বাউফলে জামায়াত শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে, তাদের প্রতিহত করতে হবে’ Dec 09, 2025
img
কর্মস্থলে উপস্থিতির প্রত্যয়ন ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষকরা বেতন পাবেন না Dec 09, 2025
img
আবু সাঈদ মামলার ঘটনায় হাসনাত আবদুল্লাহর সাক্ষ্য-জেরা শেষ Dec 09, 2025
img
'আশ্রম' বিতর্কে অবশেষে মুখ খুললেন তৃধা Dec 09, 2025
img
ক্ষমতাচ্যুতদের পালাতে সাহায্যকারীদের ভোট না দেওয়ার আহ্বান দুদক চেয়ারম্যানের Dec 09, 2025
img
ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় Dec 09, 2025
img
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মাউশির জরুরি নির্দেশনা Dec 09, 2025
img
বুধবার জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ Dec 09, 2025
img

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

‘লুকিয়ে রাখা টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ায় কোটিপতি হিসাবের সংখ্যা বাড়ছে’ Dec 09, 2025
img
রাশেদ খানকে মুখে ‘লাগাম টেনে’ কথা বলার হুঁশিয়ারি বিএনপি নেতার Dec 09, 2025
img
রণবীর ও তার পরিবার নিয়ে তথ্য ফাঁস করলেন পীযূষ Dec 09, 2025