গণপূর্তের ৮০ ভাগ টেন্ডারে জি কে শামীমের থাবা  

রাজধানীতে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানে সারাদেশে পরিচিতি পাওয়া যুবলীগ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ( জি কে শামীম) ছিলেন মূলত ‘টেন্ডার কিং’। বড় বড় টেন্ডার বাগাতে ‘টোপ’ ফেলতেন তিনি। যেখানে যে কৌশলে কাজ হবে সেটি তিনি সহজে বুঝতে পারতেন।

এক্ষেত্রে দামি উপঢৌকন,স্বর্ণালঙ্কার এমনকী অবস্থা বুঝে সুন্দরী মডেলদের ব্যবহার করতেন শামীম। মোটা অঙ্কের টাকায় ভাড়া করা এসব মডেলদের দিয়ে ম্যানেজ করা হতো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে। এভাবে তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মেগা প্রকল্পগুলোর ৮০ ভাগ টেন্ডারেও ভাগ বসান।

জিয়া নামে এক ব্যাক্তির সঙ্গে শামীমের মুঠোফোনে কথা বলার ভয়েস রেকর্ড থেকে এমন তথ্য জানা গেছে।

ভয়েস রেকর্ড থেকে জানা যায়, জি কে শামীম প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গেই অবৈধ কমিশন ও ঘুষ লেনদেনের আলাপ করেন নিজের মোবাইল ফোনে। তবে প্রমাণ রাখতে অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তা বলার পর ফোনে তা রেকর্ড করে রাখতেন।

আবার অনেকের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, মেসেঞ্জার ও ইমো ব্যবহার করে কথাবার্তা বললেও অন্য আরেকটি ফোনে তা রেকর্ড করে রাখেন। এ কারণে শামীমের মোবাইল ফোনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে বিবেচনা করছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।

ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িতদের ভয়েস চিহ্নিত করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সূত্র জানায়, জিয়া নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনের একাধিক ভয়েস রেকর্ড রয়েছে তার মোবাইল ফোনে। এসব কথোপকথনের বেশির ভাগই চিত্রজগতের নায়িকা, উঠতি মডেল ও শোবিজ জগতের তারকাদের ঘিরে।

টেন্ডার সংক্রান্ত কাজে তিনি অনেক সময় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করতে এসব মডেল ও উঠতি নায়িকাদের ব্যবহার করতেন।

সূত্র বলছে, জি কে শামীমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরেই পূর্ত মন্ত্রণালয়ে দাপটের সঙ্গে ঘোরাফেরা করেন তার নাম জিয়া। অথচ তিনি পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী নন। আবার তিনি কোনো রাজনৈতিক নেতাও নন।

তবে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সর্বস্তরে তার প্রভাব চোখে পড়ার মতো। সবাই তাকে দেখলে সালাম দেয়, সমীহ করে।লিফটম্যানরা তটস্থ হয়ে পড়ে। মন্ত্রীর কক্ষে ঢোকার আগেই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকেন কর্মচারীরা।

জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে যে কয়জন সিঙ্গাপুরে মেরিনা বে ক্যাসিনোতে নিয়মিত জুয়া খেলতে যান জিয়া তাদের অন্যতম। সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোতে জিয়া হাজার হাজার ডলার উড়িয়ে দেন অবলীলায়। দেশের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় চলাফেরা করেন হেলিকপ্টারে।তার বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি।

জিয়া থাকেন রাজধানীর গুলশান-১ এ। গুলশান-২ এর হোটেল ওয়েস্টিনে তাকে নিয়মিত দেখা যায়। এই জিয়ার রাজনৈতিক ‘হট কানেকশন’ সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। বিএনপি আমলে তিনি বিএনপির লোক।আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লীগ। টেন্ডার বাগিয়ে আনতে তাকে ব্যবহার করতেন জি কে শামীম।

এছাড়া টেন্ডার হলেই জি কে শামীমের কাছ থেকে যুবলীগের কমিশন হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকার ভাগ পেতেন যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরি সম্রাট।

গ্রেপ্তারের পর জি কে শামীমের অফিস কক্ষ থেকে উদ্ধারকৃত খাতাপত্র ও টেলিফোনের ভয়েস রেকর্ড থেকে কমিশনপ্রাপ্তদের নামের তালিকাসহ এসব তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

র‌্যাব বলছে, জি কে শামীমের সঙ্গে সমাজের প্রভাবশালী অনেকের হট কানেকশন ছিল। রাজনৈতিক পদ-পদবিধারী নেতা ছাড়াও ৫-৬ জন মন্ত্রীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল ওপেন সিক্রেট।

তার ৩টি মোবাইল ফোনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। কাজ পেতে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পাশাপাশি সচিব থেকে শুরু করে প্রকৌশলীদের কাউকেই প্রাপ্য কমিশন থেকে বঞ্চিত করতেন না তিনি।

র‌্যাব আরও জানায়, জি কে শামীম অভিনব উপায়ে টেন্ডারবাজি করতেন। সম্প্রতি ই-টেন্ডার পদ্ধতি চালু হওয়ায় মূলত জি কে শামীমের মতো ঠিকাদারদের আরও সুবিধা হয়েছে।

কারণ আগে থেকেই দরপত্রে এমন শর্ত যোগ করা হয় যাতে পূর্বনির্ধারিত ঠিকাদার হিসেবে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানই কাজ পায়। এজন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও অধিদপ্তরের উচ্চপর্যায়ে নীতিনির্ধারকরা নির্ধারিত রেটে কমিশন নিতেন।

দীর্ঘদিন ধরে এমন কমিশন লেনদেনের ফলে জি কে শামীম অনেক কর্মকর্তারই আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ফলে পূর্ত সংক্রান্ত মেগা প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান জিকেবিপিএল যুক্ত থাকে।

কোনোটি তিনি নিজেই করেন। আবার কোনো কোনো কাজ জেভি’র (যৌথ উদ্যোগ) মাধ্যমে করেন। আবার বেশ কিছু কাজ তিনি অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৫ থেকে ৭ পার্সেন্ট কমিশনে বিক্রি করে দেন।

রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের বেশ কয়েকটি কাজ নিতে জি কের প্রতিষ্ঠানকে রীতিমতো মোটা অঙ্কের কমিশন দিতে হয়।  এভাবে রূপপুরে কাজ পায় সাজিন ট্রেডার্স, এনডিই, পায়েল, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স, জামাল অ্যান্ড সন্স ও হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স।

র‌্যাব জানায়, জি কে শামীমের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র, মানি লন্ডারিংয়ের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে একাধিক মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে মাদক বা অস্ত্রের যে কোনো একটি মামলা তদন্ত করবে র‌্যাব। তে করে আইনের ফাঁক গলে তার মুক্তি পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে আসে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম গণমাধ্যমকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে জি কে শামীমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিভিন্ন মহলে তার হট কানেকশনের কথা শুনেছি। তবে আইনের চেয়ে কারও হাত লম্বা নয়। সে যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, অপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে।

এর আগে শুক্রবার রাজধানীর গুলশানের নিকেতনের কার্যালয় থেকে সাত দেহরক্ষীসহ গ্রেপ্তার করা হয় শামীমকে। বর্তমানে তিনি দুটি মামলায় মোট ১০ দিনের পুলিশি রিমান্ডে রয়েছেন।

 

টাইমস/এমএস 

Share this news on:

সর্বশেষ

ব্যক্তিগত ভিডিও নিয়ে স্ত্রী সহ বিপাকে টকশো আলোচক ডা. জাহেদ Sep 19, 2025
img
এনসিপির সেই নেত্রীকে অব্যাহতি Sep 19, 2025
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা মানার পরামর্শ দিল ভারতীয় কূটনীতিক Sep 19, 2025
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কতটা এগিয়ে চীন Sep 19, 2025
পরিবর্তিত অবস্থায় ভারতের সাথে কি ঘনিষ্ঠ হতে যাচ্ছে জামায়াত? Sep 19, 2025
চাকসুতে ছাত্রশিবিরের প্যানেল ঘোষণা Sep 19, 2025
img
নুরুল হক নুরের শারীরিক অবস্থা জানিয়ে জরুরি বার্তা Sep 19, 2025
img
‘যিনি দলের নির্দেশনা ভঙ্গ করেননি তাকেই দল মনোনয়ন দেবে’ Sep 19, 2025
img
ইলিয়াসের গায়ে হাত দিলে আমি তারে ছাইড়া দিবো না Sep 19, 2025
img
টেকনাফের গহীন পাহাড়ে বন্দি ৬৬ জনকে উদ্ধার Sep 19, 2025
img
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হেলিকপ্টারের জরুরি অবতরণ Sep 19, 2025
img
রাশিয়ায় ৭.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প, সুনামি সতর্কতা জারি Sep 19, 2025
img
ওয়েলালাগের বাবা আর নেই শুনে ‘সরি’ বললেন নবি Sep 19, 2025
img
ঢাকায় ঝটিকা মিছিলের প্রস্তুতিকালে আ.লীগের ১১ জন গ্রেপ্তার Sep 19, 2025
img
সুপার ফোরে কবে কার বিপক্ষে মাঠে নামবে বাংলাদেশ Sep 19, 2025
img
দুনিথ ওয়েলালাগের বাবা আর নেই Sep 19, 2025
img
আফগানদের হারিয়ে বাংলাদেশকে নিয়েই সুপার ফোরে গেল শ্রীলঙ্কা Sep 19, 2025
img
চবি ভিসি-প্রোভিসির সঙ্গে স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা উপদেষ্টার মতবিনিময় Sep 19, 2025
img
কাশিমপুর থানা আ.লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গ্রেপ্তার Sep 18, 2025
img
জ্যান ফ্রাইলিঙ্কের রেকর্ড ফিফটিতে জিম্বাবুয়েকে হারাল নামিবিয়া Sep 18, 2025