মেয়েটিকে আমরা বেঁচে থাকতে দিলাম না…

বান্দরবান থানচি উপজেলার যোসেফ পাড়ার বাসিন্দা লিয়ানা ত্রিপুরা পপি (২৩)। চার বছর আগে উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। পড়াশুনার পাশাপাশি গুলশানের একটি বিউটি পার্লারে চাকরি করতেন তিনি।

গত শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পার্লারে যাওয়ার সময় গুলশানে একটি প্রাইভেট কারের (ঢাকা মেট্রো ঘ ১৩০৯০২) ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই মারা যান পপি।

মঙ্গলবার রাতে তাকে নিয়ে একটি মর্মস্পর্শী ফেসবুক পোস্ট দিয়েছে মুক্তমনা লেখক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ। নিচে তার পোস্টটি বাংলাদেশ টাইমস পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

গুলশান এলাকায় প্রকাশ্যে দিনের আলোতে তেইশ চব্বিশ বছর বয়সের ফুটফুটে একটি মেয়ে গাড়ির ধাক্কায় নিহত হলো, এই খবরটা আমাদের খবরের কাগজ বা টেলিভিশনের জায়গা করে নিতে পারেনি। বিশাল এই পৃথিবীতে কত বড় বড় ঘটনা ঘটে চলেছে, মানুষের কত রকম প্রায়োরিটি, এসবের ফাঁকে পাহাড় থেকে আসা আদিবাসী একটি হতভাগী মেয়ের দুর্ঘটনায় মৃত্যু, বাইরে থেকে দেখলে খবর হিসেবে আসলেই হয়তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু আপনি যখন কাছে থেকে দেখবেন, আপনজন হিসেবে দেখবেন, তখন বুঝবেন এটি একটি মেধাবী সন্তানের মৃত্যু, একজন মমতাময়ী বোনের মৃত্যু, একজন প্রাণবন্ত আন্তরিক বন্ধুর মৃত্যু কিংবা কে জানে, হয়তো কারো সোহাগী প্রেমিকারও মৃত্যু এটা।

আপনজনের কান্না তো গ্লোবাল নিউজ ভ্যালু বুঝে না। ওদের পৃথিবীতে চোখের জলে আপনাদের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ধোঁয়াশা হয়ে যায়।

লিয়ানা ত্রিপুরা পপি। বান্দরবানের মেয়ে, বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। তেইশ বছর বয়স। ঢাকায় থেকে পড়াশুনাটা চালিয়ে যাচ্ছিল আর সেই সাথে কাজও করতো। এ মাসের ১৮ তারিখ সকাল সকাল গুলশানে ওর কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছিল রিকশায় করে। পেছন থেকে একটি প্রাইভেট কার ওর রিকশায় আঘাত করে। মৃত্যু হয় পপির। পপির ছোট ভাই গুলশান থানায় মামলা করে। গাড়িটির নম্বর ধরে গাড়িটি শনাক্ত করা হয়েছে। গাড়িটি চালাচ্ছিল একটি কিশোর- অত্যন্ত বিত্তবান ঘরের ছেলে।

 (২)

গুলশানের মতো এলাকায় সকাল সাড়ে দশটার একটু পর ঘটনা ঘটেছে। গাড়ির নম্বর শনাক্ত করা আছে, গাড়ির মালিক কে সেটাও জানা। গাড়ি চালাচ্ছিল যে ছেলেটি তাকেও শনাক্ত করা আছে। তারপরও আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ঘটনা ঘটার আড়াই দিন পর। এর মধ্যে গাড়ি চালাচ্ছিল যে কিশোর, তার পরিবারকে সুযোগ দেয়া হয় নিহত পপির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে ওদেরকে চাপ দেয়ার। বিত্তবান ঘরের ছেলেরা এ রকম গাড়ি চাপা দিয়ে মানুষ মেরে ফেললে কি রকমভাবে ওরা সামলায় সে তো আপনারা জানেন।

পপির ছোট ভাই জয়ন্ত ওর ফেসবুকে লিখেছে, ‘দিদি ওরা আমাকে (৫০০০০) পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে এসেছে, কতটা নিষ্ঠুর দেখ তুই, টাকা দিয়ে জীবনের মূল্য দিতে এসেছে, পৃথিবীর সব সম্পদ আমার হাতে এনে দিলেও তোর মূল্য কি তুলনাযোগ্য? আমার কাছে আমার বোনটা পৃথিবীর সবচাইতে বড় দামি, পারবে? আমাকে টাকা দিয়ে, দিদির মুখ থেকে ভাই ডাকটি আবার শুনাতে? ভাই বলে বুকে জড়িয়ে ধরতে? কপালে চুমু দিতে? আমার হাতটি শক্ত করে ধরতে?’

ওরা চেয়েছে সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে ছোট ভাইটিকে প্রভাবিত করে আপস টাপস করে বিত্তবান ঘরের নষ্ট কিশোরটিকে রক্ষা করতে। এই ছোট ছেলেটির দৃঢ় অবস্থানের কারণে ওরা হয়তো এই পর্যায়ে ঘটনা ধামাচাপা দিতে পারেনি- কিন্তু এইরকম বিত্তবান ও ক্ষমতাবান ঘরের নষ্ট ছেলেরা গাড়ি চাপা দিয়ে মানুষ হত্যা করার পরও আইন কানুন সবকিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে এ রকম ঘটনা কি আপনারা দেখেননি? বেশি দিন আগের কথা তো নয়, এক এমপিপুত্র দামি গাড়ি দিয়ে একজনকে হত্যা করে পার পেয়ে গেছে, ভুলে গেছেন?

এইখানেও এই চেষ্টা হয়েছে। ঘটনা ঘটেছে ১৮ তারিখ সকাল ১১টার একটু আগে অথচ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২০ তারিখ রাতে। এই তিনটি দিন ঘাতকের পরিবারকে সুযোগ দেয়া হয়েছে ধামাচাপার চেষ্টা করতে। বলা হচ্ছে, ঘাতক কিশোরটির বয়স নাকি ১৭। আমার ধারণা ছেলেটিকে অপ্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে শিশু হিসেবে চালিয়ে দিয়ে অপরাধের গুরুত্ব ও সম্ভাব্য শাস্তি কমানোর মতলবে ইচ্ছা করেই ছেলেটির বয়স কমিয়ে দেখানো হয়েছে। হয়তো দেখা যাবে ওর প্রকৃত বয়স ১৮ পার হয়ে গেছে।

 লিয়ানা ত্রিপুরা পপি

(৩)

ছোটখাটো আকৃতির ফুটফুটে চেহারার আদিবাসী এই মেয়েটি খুবই হাসিখুশি থাকতো। আমরা জেনেছি ও ছবি তুলতে খুব পছন্দ করতো। ছোট ভাইটিকে খুবই বিরক্ত করতো, ফটো তুলে দে ফটো তুলে দে। ভাইটিকে বলতো, তুই তো খুবই ভালো ফটো তুলিস, এ জন্যেই তোকে বলি ফটো তুলে দিতে। খুব স্বচ্ছল ঘরের বাচ্চা ওরা হয়তো নয়- কিন্তু নিতান্ত হতদরিদ্র ঘরেরও নয়। আত্মনির্ভরশীল ছিল, এই বয়সেই নিজের জীবনযাপনের ব্যয় নিজেই আয় করার চেষ্টা করতো।

আমি অনুমান করি পপি স্বাধীনচেতা শক্ত মেরুদণ্ডওয়ালা মানুষ ছিল- পাহাড়ি আদিবাসী শিক্ষিত মেয়েরা সাধারণত এ রকমই হয়। কিন্তু সে তো তেইশ বছরের একটা প্রাণবন্ত তরুণীই ছিল। আমার পরিবারের মেয়েরা বা বন্ধুবান্ধবের মেয়েরা বা আমার ফেসবুক বন্ধুরা মিলিয়ে একঝাক এই বয়সের তরুণীকে আমি চিনি। ওরা এই ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়ায়, ক্লাসে যায়, কেনাকাটা করতে বা আড্ডা দিতে বা টিউশনি করতে বা লুকিয়ে প্রেম ট্রেম করতে ওরা একা একা চলাফেরা করে। পপি ত্রিপুরা তো ওদেরই একজন। ওদের জন্যে আমাদের এই নগরটা কি নিরাপদ নয়?

না, আমরা এখন যত মন খারাপই করি না কেন পপিকে তো আমরা ফেরত আনতে পারব না। পপির বাবা মায়ের শূন্য বুক তো শূন্যই থেকে যাবে। জয়ন্তের জন্যে ওর বোনের ভালোবাসা তো আর ফিরিয়ে দিতে পারব না আমরা। কিন্তু বিচার তো আমরা চাইতে পারি- ঘাতকের শাস্তি তো চাইতে পারি। কেননা এই বিচারটি আমাদের সকলের জন্যে জরুরি। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে আমাদের এই নগরটিকে একটি নিরাপদ নগরী হিসাবে দেখতে চাই। আমাদের এই নগরটি তো কেবল বিত্তবান মানুষের ছেলেদের জন্যে বা ওদের মেয়েদের জন্যেই মাত্র নয়- এই নগরটি তো আমাদের সকলের ছেলেমেয়েদের জন্যে।

(৪)

এইটাই শুধু আমি চাই- আপনারাও একটু কণ্ঠ খুলে দাবি করেন বিচারটা যেন ঠিকঠাক মত হয়। এই পোড়ার দেশে এমনিতেই তো চট করে বিচার-টিচার হয় না। বিচার হয় শুধুমাত্র সেসব ক্ষেত্রে যেসব ক্ষেত্রে আপনি আর আমি সোচ্চার হই। সুদূর বান্দরবন থেকে এই মেয়েটা দুই চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল আমাদের এই নগরে। আমরা ওকে বেঁচে থাকতে দিলাম না। এই অপরাধের একটুও দায় কি আপনার আমার নাই?

এই ছবিটা দেখেন, এই তো সেদিন, জুনের ১৬ তারিখে জয়ন্ত ওর দিদির জন্মদিনে জয়ন্ত পোস্ট করেছিল এই ছবিটা। লিখেছিল, people come and go, friends change like the weather but I know my sister is here forever. I love you. happy birthday di... সাথে অনেকগুলো লাল হৃদয়ের ইমোটিকন। ওর দিদিটি আর নেই।

ইমতিয়াজ মাহমুদ

লেখক ও আইনজীবী

 

টাইমস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিএনপি খালেদা জিয়ার দল, তারেক রহমানের দল: রুমিন ফারহানা Jul 19, 2025
img
তদবির নয়, এবার বিচারপতি নিয়োগে কাঠামোগত পরিবর্তন Jul 19, 2025
img
সুইজারল্যান্ডকে হারিয়ে উইমেন্স ইউরোর সেমিফাইনালে স্পেন Jul 19, 2025
img
ড্রোন ও এআই অস্ত্র নির্মাণে যৌথভাবে কাজ করবে যুক্তরাজ্য-জার্মানি Jul 19, 2025
img
স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ২৫ কেজি দুধে স্নান করলেন হৃদয় মিয়া Jul 19, 2025
img
হাই অল্টিটিউড ম্যাচে কতটা প্রস্তুত জামালরা? Jul 19, 2025
img
সমর্থক গ্রেফতারে শীর্ষে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড Jul 19, 2025
img
সরকারই উসকানি দিয়ে এনসিপিকে গোপালগঞ্জ পাঠিয়েছে : এলডিপি মহাসচিব Jul 19, 2025
img
বাংলাদেশ সরকারের কাজের প্রশংসা করলেন স্পেসএক্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট Jul 19, 2025
img
কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের লোক ছাত্রদের দল গঠনের বুদ্ধি দিয়েছে : অলি আহমদ Jul 19, 2025
img
পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ চায় না বিএনপি Jul 19, 2025
হলফনামায় শেখ হাসিনার মি'থ্যা তথ্য, ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই ইসির Jul 19, 2025
img
মুজিববাদের কবর দিতে গোপালগঞ্জ যাওয়ার দরকার নেই : এ্যানি Jul 19, 2025
বাংলাদেশে স্টারলিংক কার্যক্রমে সরকারকে ‘নজিরবিহীন’ বললো স্পেসএক্স Jul 19, 2025
‘হিরোস উইদাউট কেপস’ ডকুমেন্টারি: জুলাই আন্দোলনের প্রামাণ্য চিত্র Jul 19, 2025
img
জামালপুরে যুব মহিলা লীগ নেত্রী গ্রেফতার Jul 19, 2025
img
বাংলাদেশে স্টারলিংক আনুষ্ঠানিকভাবে চালু, রিসেলার বিএসসিএল Jul 19, 2025
img
দলীয় উন্নয়নেই মনোযোগ, আজও দ্বিতীয় সারির দল পাঠাবেন বাটলার Jul 19, 2025
img
পাকিস্তানের ইরানি দূত এখন এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড Jul 19, 2025
img
এসি মিলানে মডরিচ, ফিরে গেলেন ছোটবেলার প্রেমে Jul 19, 2025