নীল চাষ নাকি তৈরি পোশাক শিল্পের গ্লোবালাইজেশন : বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

শিরোনামটি নিশ্চয়ই পছন্দ হয়নি। হওয়ার কথাও না। কিন্তু বাস্তবতা মেনে নেয়া এই শিরোনামের চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ। তাছাড়া আমরা বাস্তবতা মেনেই নিয়েছি। ব্রিটিশ কলোনিয়াল পাওয়ার উপমহাদেশ দখল করার পর বাংলায় নীলচাষের ভয়ংকর ইতিহাস অনেকেই পড়েছেন বা জেনেছেন।

ব্রিটিশ বেনিয়ারা বাংলার কৃষকদের ওপর যে অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ বা নিপীড়ন চালিয়েছিল তা নিয়ে দীনবন্ধু মিত্র লিখে রেখে গেছেন নাটক 'নীল দর্পন' (১৮৬০)। যা তৎকালীন সময়ে নীলচাষীদের বিদ্রোহের অনুপ্রেরণা যোগাতে সাহায্য করেছিল। নীল এমনই এক উদ্ভিদ, যা উৎপাদন করলে জমির উর্বরতা শক্তি একদমই ধ্বংস হয়ে যায়। আর তখন গ্লোবালাইজেশনের সুযোগ সন্ধানী ব্রিটিশ বেনিয়ারা বাংলার কৃষকদের নীল চাষ করতে বাধ্য করতো।

আর কৃষকদের রক্তে রঞ্জিত নীল নিয়ে যেতো সুদূর ব্রিটেনে। এটাকে আউটসোর্সিংও বলতে পারেন। একটি ফাইনাল বা চূড়ান্ত পণ্য উৎপাদন করতে বিভিন্নরকম মধ্যবর্তী পণ্যের প্রয়োজন। সেই পণ্যগুলো যেখানে কম খরচে পাওয়া যায়, স্বাভাবিক ভাবে সেখান থেকেই সংগ্রহ করার চেষ্টা করবেন উদ্যোক্তা। অর্থাৎ আপনাকে মুনাফা সর্বোচ্চ করতে হলে খরচ কিন্তু সর্বনিম্ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে গ্লোবালাইজেশনের যে বলিষ্ঠ ভূমিকা, তা অস্বীকার করার কোনও সুযোগ তখনও ছিল না, এখনও নেই।

তাছাড়া বাংলার জমিতে নীল চাষ করলে, এতে খরচও কম ছিল। কারন কৃষকদের শোষণ বা জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করার যাবতীয় সুযোগ সুবিধাই সেখানে ছিল। তবে এখনো যে নেই, সেটা কী করে বলি?

কলোনিয়ালিজম এখন নিও কলোনিয়ালিজমে বা গ্লোবালাইজেশনের রূপেই রয়ে গেছে। অর্থাৎ নামেই শুধু পরিবর্তন। আর গুণগত পরিবর্তন বললে, বলতে হবে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বা উন্নয়ন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণগত পরিবর্তন যেটা দরকার ছিল, সেটা হচ্ছে তার মৌলিক আচরণগত পরিবর্তন। যতোদিন সেটা হবে না, ততোদিন গ্লোবালাইজেশনের সুফল শোষিত (Proletariat) শ্রেণি ভোগ করতে পারবে না। তাছাড়া শোষিত মানুষের পাশে দাড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললে গ্লোবালাইজেশনের বিরোধী হিসেবে আপনাকে অভিহিত করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

গ্লোবালাইজেশন নিয়ে বহু বিজ্ঞ, জ্ঞানীগুণী মানুষ লিখেছেন, কথা বলেছেন, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। কেউ কেউ ইতিবাচক দৃষ্টিকোন থেকে গ্লোবালাইজেশনকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন বা এখনো করে চলেছেন। আবার এর নেতিবাচক দিক নিয়েও অনেকেই সমালোচনা করেছেন। তাছাড়া যেকোনো বিষয়ে ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাইহোক না কেনো যৌক্তিক আলোচনাটাই মূখ্য।

সেক্ষেত্রে যারা ইতিবাচকের পক্ষে থাকেন, তারা যদি যৌক্তিক নেতিবাচক কথাগুলো গ্রহণ করার মানসিকতা অর্জন করতে না পারেন, তাহলে তাদের চিন্তাশক্তি নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হওয়াই স্বাভাবিক।

গ্লোবালাইজেশনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এর অনেক আলোচনা হয়েছে এবং এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পে গ্লোবালাইজেশনের প্রভাব নিয়েও অনেক আলোচনা বা সমালোচনা হয়েছে। আমাদের পোশাক শিল্পের বর্তমান চিত্রে বুঝাই যায় গ্লোবালি এর অনেক চাহিদা বা এটি বিশাল বাজার দখল করতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ অনেকটা এরকম বলা যায়, বড় বড় ঢেউয়ে বড় বড় জাহাজগুলো হয়তো ভিজেই কিন্তু ছোট নৌকাগুলো ডুবেই যায় বা তাদের ডুবিয়ে দেয়া হয় (Big vessels drive out small boats in big waves)। যেখানে ঢেউ গুলোই গ্লোবালাইজেশন।

এটা কিছুটা গ্রেশামের 'ল' এর মতো, ‘খারাপ টাকা ভালো টাকাকে বাজার থেকে বের করে দেয়’ (Bad money drives out good)। এখানে ভালো টাকা বলতে বোঝানো হয়েছে যে, তার গায়ে লেখা মূল্যের চেয়ে তার প্রকৃত (যেই ধাতু দিয়ে তৈরি তার পরিমানের মূল্য) মূল্য বেশি। তবে বড় জাহাজগুলোর সাথে খারাপ টাকার তুলনা না করে বরং তারা (জাহাজ বা বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বা এর ক্রেতা যারা পৃথিবীর নামিদামি ব্র্যান্ড) গ্লোবালি কিভাবে এতটা শক্তিশালী তা নিয়েই কিছুটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। কিংবা আদৌ কি আমাদের পোশাক শিল্প গ্লোবালি পাওয়ারফুল জাহাজ হতে পেরেছে?

তৈরি পোশাক রফতানিতে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। যথারীতি প্রথম অবস্থানে রয়েছে চীন, তৃতীয় অবস্থানে ভিয়েতনাম এবং পরবর্তী শীর্ষ দেশগুলো হচ্ছে ভারত, তুরস্ক, হংকং, যুক্তরাজ্য, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়া। তবে শুধু বস্ত্র বা কাপড় (তৈরি পোশাক নয়) আমদানিতে বাংলাদেশের অবস্থান কিন্তু চতুর্থ। তাছাড়া আমাদের দেশে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তৈরি পোশাক শিল্পে মূল্য সংযোজনের (Value addition) পরিমাণ হচ্ছে ৫৬.৪৯%। অর্থাৎ এই শিল্পে কাঁচামালের সংকট (Backward integration) রয়েছে। এই কাঁচামালগুলো যেমন ডাইয়িং এর জন্য কেমিক্যাল, জিপার, বিভিন্ন ধরনের লেভেল, বোতাম বা আরও যে সমনস্ত অ্যাক্সেসরিজ রয়েছে সেগুলোর ৮৫% আসে চীন থেকে। পাশাপাশি প্রায় ৪৪ লক্ষ শ্রমিক এই শিল্পের চাকাকে ঘুরিয়ে অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রেখেছেন।

কিন্তু সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক বিষয় হচ্ছে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য। যে সকল শীর্ষস্থানীয় দেশ তৈরি পোশাক রফতানি করে থাকে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের শ্রমমূল্য সবচেয়ে কম। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মাসিক গড় বেতন যেখানে ১০১ ডলার, সেখানে কম্বোডিয়া দিচ্ছে ১৭০ ডলার, ভিয়েতনামে ২৩৪ ডলার, মিয়ানমারে ১৩৫ ডলার এবং চীন দিচ্ছে ৫১৮ ডলার।

বিভিন্ন রকম পরিসংখ্যানলব্ধ তথ্য উপাত্তের আলোকে বলা যায় যে, পোশাক শিল্পের অন্যতম চালিকাশক্তি হচ্ছে আমাদের শ্রমশক্তি। অর্থাৎ এই শিল্পের মুনাফার যোগানদাতাই হচ্ছে শোষিত শ্রমিকশ্রেণী যারা গ্লোবালাইজেশনের কিছু ডিঙ্গি নৌকাকে জাহাজে বা জায়ান্টে পরিনত করেছেন। আর বিনিময়ে নিজেকে আবিষ্কার করেছে আর্থসামাজিক নিরাপত্তাহীনতার গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া পোশাক শিল্পের কাঁচামাল রূপে। তাহলে কি বলা যায় না যে, আসলে আমরা এখনো নীলই চাষ করছি?

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বা সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল, বিশ্ব বানিজ্য সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বড় বড় ক্রেতা (বিশ্বের সব নামিদামি ব্র্যান্ড) যারা গ্লোবালাইজেশনকে ধারণ করে, লালন করে এবং প্রমোট করার চেষ্টায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তারা আ্মাদের পোশাক শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কী উদ্ব্যোগ নিয়েছেন? আর নিলেও তার কী প্রভাব পড়েছে? হয়তো কিছু গার্মেন্টসের মালিক তাদের দেয়া প্রেসক্রিপশন মেনে নিয়েছেন বা নেয়ার চেষ্টা করছ্নে।

বড় বড় গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাকের ক্রেতারা বা নামিদামি ব্র্যান্ড কিভাবে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একচেটিয়া বাজার বা মনোপলি পাওয়ার সৃষ্টি করতে সমর্থ হচ্ছ্নে? এদেরকে মার্কেট মনোপলি বললে ভুল হবে না। কেননা এখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নেই। তবে মার্কেট মনোপলি হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে উৎপাদনে দক্ষতা অর্জন এবং কোনও গুরুত্বপূর্ণ মধ্যবর্তী পণ্যের মালিকানা। এই শিল্পে কি এই শর্তগুলো প্রতিষ্ঠিত করেছে? এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা উচিত তা হলো শ্রমিকদের কাজের শ্রেণিবিন্যাস বা বিশেষায়িতকরন, যাকে অনেকেই দক্ষতা বলে থাকেন। কারন এতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কাজের এই শ্রেণিবিন্যাসের ফলে শ্রমিকদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান কি তারা পরবর্তীতে কাজে লাগাতে পারে?

আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের গরীব জনগোষ্ঠীর অবস্থা হচ্ছে, এখানে আমরা বেঁচে থাকি গ্লোবালাইজেশনের আশীর্বাদে আর মরে যাই স্রষ্টার ইচ্ছায়। অর্থাৎ গ্লোবালাইজেশন একজনকে প্রমোট করে বা এগিয়ে দিয়ে, একলক্ষ মানুষকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রেখে, অস্বাস্থ্যকর খাবার খাইয়ে, অপুষ্টিতে ভুগিয়ে, অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই একই অবস্থা চালু রাখতে চায়। তারা কখনোই ক্ষ্যান্ত হবে না।

বাংলাদেশে কোভিড ১৯ এর কারনে সরকারের দেয়া কর্মসূচি যেমন আংশিক লকডাউন, পুরো লকডাউন, কঠোর লকডাউন বা শাটডাউন যাই হোক না কেন কাপড়ের কারখানা (গার্মেন্টস) কিন্তু তার অবস্থানে অনড় থেকে নিজেকে গ্লোবালাইজেশনের একজন অবিচ্ছেদ্য, অপ্রতিরোধ্য, অপার সম্ভাবনার চিরন্তন এবং একমাত্র টেকসই অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় বদ্ধপরিকর। তাছাড়া বাংলাদেশের আয়ের প্রধান খাতই হচ্ছে এই গার্মেন্টস শিল্প। সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই এটা বলা অন্যায় নয় যে এই কাপড়ের ব্যবসার যে অর্থনীতি, সেটাতো গ্লোবালাইজেশনের কল্যাণেই।

বুর্জোয়া পুঁজিবাদী দয়ার, মানবতার (নির্মম বা শোষক) সাগরের জাহাজের ক্যাপ্টেনরা শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করেছেন? নাকি গ্লোবালাইজেশনের আশীর্বাদপুষ্ট শ্রমিক শ্রেণী বিশেষ সুবিধায় ভ্যাকসিন পেয়েছেন? যদি না পেয়ে থাকেন, তাহলে বলতে হবে আমরা এখনো নীল চাষ করেই যাচ্ছি। তবে এটাও বলতে পারেন তারা মৃত্যুর ভয়কে করেছে জয়। পেটের ক্ষুধার কাছে চির পরাজিত মহামারী। তবে এই পরাজয় আসলে কার? আমাদের নাকি গ্লোবালাইজেশনের? নাকি পরাজয় শুধুই পরাজিতের? নাকি শোষক শ্রেণির ক্ষনস্থায়ী ক্ষমতায় লালিত অহংকারে নিমজ্জিত জাগতিক লালসার?

 

লেখক- সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি), মিরপুর, ঢাকা

 

Share this news on:

সর্বশেষ