জুলাই সনদ

বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের সুপারিশ করবে কমিশন

জুলাই জাতীয় সনদের সাংবিধানিক প্রস্তাবগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে বিশেষ সাংবিধানিক সংস্কার আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নের সুপারিশ করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আর অন্য প্রস্তাবগুলো নির্বাহী আদেশ ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পরামর্শ দেবে তারা।

রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্তকরণ এবং বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত হয় বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রূপরেখা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর ) কমিশনকে একটি খসড়া দেবে। এছাড়া বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির কারণে জুলাই সনদের খসড়ার অঙ্গীকার অংশে ভাষাগত কিছু পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত হয়।

কমিশন সূত্র আরও জানা যায়, সোমবার কিংবা মঙ্গলবারের মধ্যে সনদ ও বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে পরামর্শ দলগুলোর কাছে পাঠানো হতে পারে। একই সময়ে সনদ বাস্তবায়নে রূপরেখা সরকারের কাছে জমা দেবে কমিশন।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঐক্যমত কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গণমাধ্যমকে বলেন, রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে আাসা পরামর্শ কমিশন অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। আমরা সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করছি। সবক্ষেত্রে আইনি ও রাজনৈতিক দিক, ভালো ও মন্দ দিক খতিয়ে দেখা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, কমিশন চায় রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ যেন আইনি, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, আজকের বৈঠক বিশেষজ্ঞরা নানান পরামর্শ দিয়েছেন, সেইগুলা কোনোটাই চূড়ান্ত হয়নি। আশা করছি আগামীকাল তাদের কাছ থেকে পরামর্শের খসড়া পাওয়া যাবে।

এক প্রশ্নের জবাবে আলী রিয়াজ বলেন, জুলাই সনদ চূড়ান্ত হয়ে আছে। এখন আমরা বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করবো। তারপর আশা করছি আগামী মঙ্গলবার জুলাই সনদ রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া যাবে। একইসঙ্গে সরকারকে বাস্তবায়নের রূপরেখা দিতে পারবো।

ঐক্যমত কমিশনের পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রোববার বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্তকরণ এবং বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে অংশ নেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরিফ ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক।

আর কমিশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও মো. আইয়ুব মিয়া।

কমিশনের একজন সদস্য জানান, সভায় বিশেষজ্ঞরা সনদের চূড়ান্তকৃত খসড়া পর্যালোচনা করেন এবং বাস্তবায়নের সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কে সাংবিধানিক, আইনগত ও রাজনৈতিক দিকগুলো নিয়ে মতামত দেন।

এর আগেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথরেখা ঠিক করতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করে কমিশন। প্রথমে গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত এবং অধ্যাদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছিল তারা। কিন্তু সব দিক বিবেচনা করে সর্বশেষ বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করা যায় না বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। নানান সীমাবদ্ধতায় সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান এক বিশেষজ্ঞ।

নাম না প্রকাশের শর্তে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত একটি আদেশের মাধ্যমে সাংবিধানিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছি। বর্তমান সরকার সেটি জুলাই ঘোষণাপত্রের অধীনে জারি করবে। সেটা পরবর্তী সংসদ গ্রহণ করতে পারে, আবার নাও পারে। অন্যদিকে আদালতেও চ্যালেঞ্জের সুযোগ থেকে যায়।

এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে কি না জানতে চাইলে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ঝুঁকিতো থাকবে। এটা ছাড়া আর কিছুই করা সম্ভব না। সে ক্ষেত্রে আরেকটা হল কিছু না করা। শুরুর দিকে আমরা গণভোটের কথা বললেও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরে এসেছি। কারণ এতগুলো বিষয়ে গণভোট সংঘটিত করার পাশাপাশি বড় দল প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করতে পারে। তাই গণভোটে জুলাই সনদ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। অন্যদিকে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে বাস্তবায়নও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। ফলে সেটি বাদ দিয়েছি।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, সবকিছু বিবেচনা করে জুলাই ঘোষণাপত্রের অধীনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সংস্কার আদেশ বা সাংবিধানিক সংস্কার আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছি আমরা।

সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলোর কাছ থেকে লিখিত মতামত নিয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। বিএনপি সংবিধান সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের পক্ষে। তবে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশ কিছু দল আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চায়। জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশন বা গণভোটের মাধ্যমে এবং এনসিপি গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেয়। এর বাইরে অন্তত ১২টি দল সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয়। এর আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকেও এসব বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছিল।

সূত্র জানায়, এর আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকে উচ্চকক্ষের নির্বাচন প্রক্রিয়াসহ কিছু বিষয় গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ছিল ঐকমত্য কমিশনের। কিন্তু গণভোটের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। আইনি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় এই প্রক্রিয়া সুপারিশ না করার পক্ষে মতামত উঠে আসে।

প্রায় ১০–১২টি দল সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। তবে বিশেষজ্ঞরা জানান, এটি যথাযথ হবে না, কারণ এর আগেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে রেফারেন্স নেওয়া হয়েছিল। এর পরিবর্তে বিশেষ সংবিধান বা সাংবিধানিক সংস্কার আদেশ জারির মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেওয়া হয়।

পিএ/টিএ 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ফ্যাসিবাদ সরকার যুব সমাজকে ধ্বংসের মুখে ফেলে গেছে: শামা ওবায়েদ Oct 31, 2025
img
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে: নির্বাচন কমিশনার Oct 31, 2025
img
আসন্ন নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ফেক নিউজ : শফিকুল আলম Oct 31, 2025
img
মোবাইল ফোন হারালে ব্লক করার প্রক্রিয়া Oct 31, 2025
img
ভেনেজুয়েলায় সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র Oct 31, 2025
img
চরমপন্থা-সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপের আহ্বান পররাষ্ট্র উপদেষ্টার Oct 31, 2025
img
মহানগর ও বিশেষায়িত পুলিশ ইউনিটে চালু হচ্ছে নতুন পোশাক Oct 31, 2025
img
ডাচ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লড়াইয়ে এগিয়ে রব জেটেন Oct 31, 2025
img
কুয়েতে দুর্ঘটনার কবলে কিংসের বাস, অনুরোধ রাখেননি ম্যাচ কমিশনার Oct 31, 2025
img
তদন্তের মধ্যেই হাসপাতালে ছুটলেন শিল্পা শেঠি Oct 31, 2025
img
আমি যখন কোনো সম্পর্কে থাকি তখন আমার পুরোটা দিই: তামান্না ভাটিয়া Oct 31, 2025
img
দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়: হাসনাত Oct 31, 2025
img
জবি ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক ফয়সাল মুরাদের পদত্যাগ, পরে ডিলিট করলেন পোস্ট Oct 31, 2025
img
যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা লুটপাট দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন করেছে : এ্যানি Oct 31, 2025
img
১৮টি ওয়ার্ডের উন্নয়ন কাজ যাচাইয়ে ডিএনসিসির কমিটি গঠন Oct 31, 2025
img
জিম্বাবুয়েকে ৭ উইকেটে হারিয়ে সিরিজ নিশ্চিত আফগানিস্তানের Oct 31, 2025
img
খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেলে ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেল এক পর্যটকের Oct 31, 2025
img
সিলেটের জালাল আহমেদ ও যীশুসহ ১০ ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা-কর্মচারী পেলেন বিশেষ সম্মাননা Oct 31, 2025
img
তেল আবিবের সমুদ্র সৈকতে নেতানিয়াহুর ব্যঙ্গচিত্র Oct 31, 2025
img
প্রিন্স উপাধি হারালেন অ্যান্ড্রু, ছাড়তে হবে রাজকীয় প্রাসাদ Oct 31, 2025