ভারতে ভোটার তালিকায় একটি ঘরেই ৪ হাজার ২৭১ ভোটার!

ভারতে ভোটার তালিকায় বড়সড় গরমিলের অভিযোগ সামনে এসেছে। দেশটির উত্তরপ্রদেশের মহোবা জেলায় ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় একটি ঘরে ৪ হাজার ২৭১ ভোটারের নাম পাওয়া গেছে।

যা গ্রামজুড়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে ও ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম মুসলিম মিরর।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, উত্তরপ্রদেশের মহোবা জেলার জৈতপুর গ্রামপঞ্চায়তের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা একটি ছোট্ট ঘর। মাত্র ১৬ বাই ১৫ ফুটের এক কামরার এই ঘরটির ছাদ ঝুঁকে পড়েছে, দেয়ালের প্লাস্টার খসে গেছে, সামনে সরু বারান্দা। মালিকের কাছে এটি কেবল একটি সাধারণ বাসা হলেও ভোটার তালিকা সংশোধনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের খাতায় হঠাৎই এটি হয়ে উঠেছে ৪ হাজার ২৭১ মানুষের ঠিকানা।

২০২৬ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য চলমান ভোটার তালিকা সংশোধনকাজে এই ‘অলৌকিক’ আবিষ্কার গ্রামজুড়ে বিস্ময় ছড়িয়েছে। কাগজে-কলমে দেখা যাচ্ছে, জৈতপুরের মোট ১৬ হাজার ৬৯ জন ভোটারের প্রায় এক-চতুর্থাংশই নাকি ঠাঁই নিয়েছে ওই এক কামরার ঘরে।
বাড়ির মালিক বলছেন, “বুথ অফিসার যখন বললেন আমার ঘরে নাকি চার হাজারেরও বেশি ভোটার আছে, ভেবেছিলাম মজা করছেন”। প্রতিবেশীরাও অবাক হয়ে ভিড় জমালেন। এক জন বললেন, “পুরো গ্রাম যদি লাইন ধরেও দাঁড়ায়, এই ঘরে ফিট হবে না।”

পুরোনো ভুল, পুরোনো অজুহাত
কর্মকর্তারা অবশ্য দ্রুত এই ভুলকে ‘ক্লারিক্যাল ভুল’ বলে দায় এড়ালেন। বুথ-স্তরের অফিসারদের (বিএলও) দায়িত্ব ছিল ঘরে ঘরে গিয়ে নাম যাচাই করা। তারা খুঁজে পেয়েছেন, তিনটি ওয়ার্ডের নাম ভুলবশত বাড়ি নম্বর ৮০৩-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে।

সহকারী জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আর.পি. বিশ্বকর্মা বললেন, “গ্রামে ঘরের নম্বর ঠিকভাবে ব্যবহার হয় না। তথ্য প্রবেশের সময় বহু নাম এক ঠিকানায় জুড়ে গেছে। ভোটাররা আসল, শুধু ঠিকানার সঙ্গে গড়মিল হয়েছে।”

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কুনওয়ার পঙ্কজ সিংও স্বীকার করেন, ২০২১ সালেও একই ধরনের সমস্যার খোঁজ মিলেছিল। এবারও সংশোধনের কাজ চলছে।
শুধু জৈতপুর নয়

অবশ্য শুধু জৈতপুরেই নয়, পানওয়ারি শহরের এক বাড়িতে ২৪৩ ভোটার আর পাশের বাড়িতে ১৮৫ জনের নাম পাওয়া গেছে।
স্থানীয় কর্মী চৌধুরী রবীন্দ্র কুমার নিজেই এমনই একটি ঘরের মালিক। তিনিই প্রথম এ নিয়ে অভিযোগ তোলেন। তার কথায়, “এটা ছোট ভুল নয়। যখন একটি দলিত বাড়িতে শত শত ভোটারের নাম ঠাসা থাকে, তখন সেটা শুধু অবহেলা নয়; বরং মানুষের আস্থা নষ্ট করে।”

এআই নিরীক্ষা ও আস্থার সংকট
বিষয়টা হলো, এ সব গরমিল ধরা পড়ছে এক বছরের এআই সহায়তায় করা যাচাই অভিযানের পর। সেই নিরীক্ষায় মহোবায় এক লাখেরও বেশি সন্দেহজনক বা পুনরাবৃত্ত ভোটার শনাক্ত হয়েছিল। এর মধ্যে জৈতপুরে ২৪ হাজার, পানওয়ারিতে ২২ হাজার, কবরাইয়ে ৪৬ হাজার এবং চর্খারিতে ১২ হাজার।

এসব কাটছাঁট করতে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ২৭২টি গ্রামপঞ্চায়েতে ৪৮৬ জন বুথ কর্মকর্তাকে (বিএলও) এবং ৪৯ জন সুপারভাইজারকে দায়িত্ব দিয়েছে। ঘরে ঘরে যাচাই অভিযান চলবে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ হবে ৫ ডিসেম্বর। মৃত ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া, নতুনদের যোগ করা এবং ভুলত্রুটি সংশোধনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে তারা।

জনগণের প্রশ্ন, গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বেগ
কিন্তু মহোবার ধুলোভরা গলিতে মানুষের আস্থা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। পানওয়ারির এক বাসিন্দার প্রশ্ন, “যদি কর্মকর্তারা হাজার হাজার ভোটারকে এক ঘরে গুঁজে দিতে পারেন, তাহলে আমাদের ভোট নিরাপদ আছে কীভাবে?”

যে পরিবারের ছোট্ট ঘরটিকে এখন কাগজে হাজার হাজার ভোটারের ‘আশ্রয়স্থল’ বানানো হয়েছে, তাদের কষ্ট আরও বেশি। মালিকের আক্ষেপ, “আমরা নিজেরাই কষ্টে থাকি, এখন নথিতে দেখা যাচ্ছে পুরো গ্রাম নাকি আমাদের বাড়িতে থাকে।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিবেক ত্রিপাঠী বলেন, “গণতন্ত্র একদিনে ভাঙে না, ধীরে ধীরে দুর্বল হয়। এমন ভুল উপেক্ষা করা মানে অপব্যবহারের সুযোগ রাখা”। সমাজকর্মী রাম নারায়ণ ভোটার তালিকার এই গরমিলকে “গণতন্ত্রের ভিত খেয়ে ফেলা উইপোকার” সঙ্গে তুলনা করেছেন।

অর আম আদমি পার্টির নেতা সঞ্জয় সিংয়ের অভিযোগ, “এটা স্পষ্ট ভোট ডাকাতির উদাহরণ। এক ঘরে ৪ হাজার ২৭১ ভোটার কীভাবে? এমন অনিয়ম গণতন্ত্রে সরাসরি আঘাত। সিসিটিভি ফুটেজ ‘গোপনীয়তা’র অজুহাতে প্রকাশ না করাও সন্দেহ বাড়ায়। এভাবে চলতে থাকলে ভোট প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

এবি/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিএনপির সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধিদের আলোচনা সভা Nov 09, 2025
img
৪৭তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার সময়সূচি জানাল পিএসসি Nov 09, 2025
img
বিপিএল ফিক্সিংকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে: আসিফ মাহমুদ Nov 09, 2025
img
অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে কাউকে অপরাধী বলাটাও অপরাধ: আসিফ আকবর Nov 09, 2025
img
স্বাধীনতার পরও দেশকে আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত থাকতে দেওয়া হয়নি : জাহিদুল ইসলাম Nov 09, 2025
img
জহির রায়হান নিখোঁজের পর অভাবে গাছের পাতা খেয়েছি: সুচন্দা Nov 09, 2025
img
৫ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে 'ধুরন্ধর', ট্রেইলার লঞ্চে উন্মাদনার ঝড় Nov 09, 2025
img
জীবনধারা ৮০ শতাংশ পরিবর্তনেই স্ট্রোকের থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব Nov 09, 2025
img
দেশে যত সংকট দেখছেন সব তৈরি করা : মির্জা ফখরুল Nov 09, 2025
img
ইসলামী ব্যাংক থেকে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতে দুদকের মামলা Nov 09, 2025
img
তারেককে অনশন ভেঙে আপিল করার আহ্বান ইসি সচিবের Nov 09, 2025
img
চট্টগ্রাম নগরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের মিছিল, ৩ জন গ্রেপ্তার Nov 09, 2025
img
১৫১ বছরের পুরোনো ঘড়ির সামনে উন্মোচিত হলো টেস্ট সিরিজের ট্রফি Nov 09, 2025
img
আইনের প্রতি সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ সমর্থন রয়েছে : প্রসিকিউশন Nov 09, 2025
img
দুর্নীতির মামলায় কাজী নাবিলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা Nov 09, 2025
বিসিএস পরীক্ষার্থী এবং পুলিশের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা উত্তপ্ত Nov 09, 2025
শেখ হাসিনার রায় নিয়ে যা বললেন প্রসিকিউটর Nov 09, 2025
img
ভোটার এলাকা পরিবর্তনের সময় শেষ হচ্ছে কাল Nov 09, 2025
জামায়াতের সতর্কবার্তায় তপ্ত রাজনৈতিক সপ্তাহের আভাস Nov 09, 2025
শিক্ষকদের অর্থ না থাকতে পারে, আমাদের আছে মর্যাদা-প্রাথমিক শিক্ষক Nov 09, 2025