আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীদের আরও ঘন ঘন বাংলাদেশে আসার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সোমবার নিউইয়র্কে তার হোটেলে বিশিষ্ট মানবাধিকার রক্ষাকারীদের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠক করেন। 

আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ এক ‘গুরুত্বপূর্ণ সময়’ অতিক্রম করছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীদের আরও ঘন ঘন বাংলাদেশ সফরের আহ্বান জানিয়েছেন।

স্থানীয় সময় সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কের একটি হোটেলে অধ্যাপক ইউনূস রবার্ট এফ. কেনেডি মানবাধিকার সংস্থার সভাপতি কেরি কেনেডির নেতৃত্বে শীর্ষ মানবাধিকার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বৈঠক করেন। বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা।

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনাদের নিয়মিত বাংলাদেশ সফর করা। প্রত্যেকবার আপনারা এলে ভুলে যাওয়া বিষয়গুলো নতুন করে আলোচনায় আসে। শেষ পর্যন্ত আপনারাই জনগণের কণ্ঠস্বর।’

বৈঠকে তিনি প্রতিনিধি দলকে বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন, চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া ও মানবাধিকার সুরক্ষায় নেয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি ভেঙে পড়া ব্যবস্থা পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছি। গত বছরের হত্যাকাণ্ড তদন্তে আমরা জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তাদের প্রতিবেদনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রকাশ পেয়েছে। এরপর আমরা জাতিসংঘ মানবাধিকার মিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছি, যা একটি বড় অগ্রগতি।’

প্রধান উপদেষ্টা জানান, জোরপূর্বক গুম করে ফেলার অভিযোগ তদন্তে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। বলেন, ‘মানুষ ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে সামনে আসছে। প্রত্যেকটি ঘটনা ভয়াবহ। বছরের পর বছর ধরে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে। অনেক মানুষকে আয়না ঘরে রাখা হয়েছিল, অনেক সময় তারা জানতও না কেন সেখানে রাখা হয়েছে। কমিশন এখনও পূর্ণ প্রতিবেদন দেয়নি, তবে নিয়মিত আপডেট দিচ্ছে।’

তিনি আরও জানান, গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এরই মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবসমূহ পর্যালোচনা করছে। রাজনৈতিক দলগুলোও এই প্রক্রিয়ার অংশ। আশা করছি, জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কারগুলো অক্টোবরের মধ্যে খসড়া আকারে তৈরি হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো তাতে স্বাক্ষর করবে।

আসন্ন নির্বাচন প্রসঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা চাই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হোক অবাধ ও শান্তিপূর্ণ—এমন নির্বাচন যা বাংলাদেশে আগে কখনো হয়নি। বছরের পর বছর ভোটার তালিকায় অনেকের নাম থাকলেও তারা ভোট দিতে পারেনি। এবার আমরা বিশেষভাবে নারীদের ভোটদানে উৎসাহিত করতে চাই এবং তাদের অংশগ্রহণ উদযাপন করতে চাই। ভোটদান প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষকে জানাতে আমরা ব্যাপক প্রচারণা চালাব। আমাদের লক্ষ্য দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা।’

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘কিছু আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। কিছু শক্তি রয়েছে যারা চায় না নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। আমরা জানি না তারা কার হয়ে কাজ করছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢালা হচ্ছে, যার সুবিধাভোগী রয়েছে দেশের ভিতরে ও বাইরে। তারা সুসংগঠিত—এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়। সামনে কয়েক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

অধ্যাপক ইউনূস অর্থ পাচার প্রতিরোধে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ‘চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারের আইনি প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। আমি আশা করি মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই বিষয়ে আওয়াজ তুলবে, যেন কোনো ব্যাংক এমন অর্থ লুকিয়ে রাখতে না পারে। এটি সত্যিকার অর্থেই জনগণের অর্থ।’

বৈঠকে উপস্থিত জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা তাসনিম জারা বলেন, বাংলাদেশের তরুণরা কাঠামোগত সংস্কারের জন্য আন্দোলন করেছে, যাতে দেশ আর কখনো সেই পরিস্থিতিতে না ফিরে যায় যা জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে।

মানবাধিকার কর্মীরা দেশের সকল মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক জন সিফটন বলেন, ‘যত বেশি সম্ভব সংস্কার নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যেন সংসদ গঠনের পরও তারা এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে।’

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন—ক্যাথরিন কুপার, আইনজীবী, রবার্ট এফ. কেনেডি মানবাধিকার সংস্থা; মনদীপ তিওয়ানা, সাধারণ সম্পাদক, সিভিকাস; ম্যাথিউ স্মিথ, প্রধান নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা, ফোর্টিফাই রাইটস; সাবহানাজ রাশিদ দিয়া, নির্বাহী পরিচালক, টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট; ক্যারোলিন ন্যাশ, এশিয়া বিষয়ক পরিচালক, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল; মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, ভিজিটিং আন্তর্জাতিক পণ্ডিত, ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয় এবং জেসেলিনা রানা, জাতিসংঘ উপদেষ্টা, সিভিকাস।

ইএ/টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিএনপি মহাসচিব দেশে ফিরেই জানাবেন তারেক রহমানের ফেরার তারিখ Sep 30, 2025
img
ফের অস্বাস্থ্যকর বাতাসে ঢাকা, বিশ্বে দূষিত শহরে দ্বিতীয় Sep 30, 2025
img
ভারতকে ক্রিকেট থেকে বহিষ্কারের দাবি Sep 30, 2025
img
বাংলাদেশে হিন্দুবিদ্বেষী সহিংসতা নেই : প্রধান উপদেষ্টা Sep 30, 2025
img
সব রেকর্ড ভেঙে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে স্বর্ণ Sep 30, 2025
img

প্রণয় ভার্মা

‘স্টার্টআপ কানেক্ট’ ভারত-বাংলাদেশকে সংযুক্ত করার সেতু হিসেবে কাজ করবে Sep 30, 2025
img
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীদের আরও ঘন ঘন বাংলাদেশে আসার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার Sep 30, 2025
img
অস্ত্র সমর্পণ করবে না ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী Sep 30, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Sep 30, 2025
'সাকিব তো শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানাতে বাধ্য!' Sep 30, 2025
পিকনিক করতে ১০৪ সদস্য নিয়ে জাতিসংঘে গেছেন প্রধান উপদেষ্টা, বললেন মেজর হাফিজ Sep 30, 2025
'শিল্পীরা প্রবীণ হলেই দাম কমে যায়' Sep 30, 2025
img
হাজত থেকে পালানো যুবলীগ নেতা ফের গ্রেপ্তার Sep 30, 2025
img
৫ দলের সঙ্গে বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চ Sep 30, 2025
img
জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীরা ‍শুধু নারীদের সামনে নাচতে পারবে: কবির আহমেদ Sep 30, 2025
img
জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেলো নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি Sep 30, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালকের সাক্ষাৎ Sep 30, 2025
img
কেউ চাঁদাবাজি করলে তাকে পুলিশে দিন : শামা ওবায়েদ Sep 30, 2025
img
এশিয়া কাপ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্ত টাকার পরিমাণ জানাল কর্তৃপক্ষ Sep 30, 2025
img
জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ Sep 30, 2025