"আট যুদ্ধ থামিয়েছি, আরও একটা থামাব; আমি পারদর্শী"

রোববার ইসরায়েল যাওয়ার পথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, গাজায় যুদ্ধের অবসান ঘটেছে এবং মধ্যপ্রাচ্য 'স্বাভাবিক' হতে চলেছে। বিশ্বনেতারা এখন শান্তির পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনার জন্য একত্রিত হচ্ছেন, আর ইসরায়েল হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের মুক্তির অপেক্ষায় আছে।

ওয়াশিংটন থেকে ইসরায়েল যাওয়ার পথে এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, 'জেনে রাখুন, যুদ্ধ শেষ।'

এই শান্তি চুক্তিকে ঐতিহাসিক আখ্যা দিয়ে ট্রাম্প দাবি করেন, ৩ হাজার বছরের মধ্যে এই প্রথম ইহুদি, মুসলিম ও আরব দেশগুলো 'রাস্তায় নেমে নেচেছে'। তিনি বলেন, এই চুক্তির মাধ্যমে একসময়ের কট্টর শত্রু দেশগুলোও আজ একত্রিত হয়েছে। মিশর, সৌদি আরব ও এ অঞ্চলের অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলোও 'সবাই এই চুক্তির পক্ষে' রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

লড়াইয়ের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে সংঘাতের অবসান ঘটেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, 'যুদ্ধ শেষ।'

তিনি আস্থা প্রকাশ করেন, এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে, কারণ শত শত বছরের সংঘাতে মানুষ এখন 'ক্লান্ত'। এই শান্তি 'সবার জন্যই দারুণ ফল বয়ে আনবে' বলেও ঘোষণা দেন তিনি।

ট্রাম্প বলেন, গাজার পুনর্গঠন দ্রুত শুরু হবে। তবে এলাকাটি 'ধ্বংসস্তূপে' পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে জানান, দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন শুরুর আগে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা অপসারণ ও মৌলিক সেবাগুলো চালুর মাধ্যমে এই কাজ শুরু হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, শিগগিরই 'বোর্ড অভ পিস' নামে একটি নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হবে। বিভিন্ন দেশের নেতারা এতে অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারী হিসেবে টনি ব্লেয়ারের নাম উল্লেখ করেন তিনি।

ট্রাম্প জানান, হামাস একটি স্থানীয় পুলিশ বাহিনী গঠন শুরু করেছে; শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র এই উদ্যোগে সাময়িক অনুমোদন দিয়েছে।

এছাড়া ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রশংসা করে তাকে 'এই মুহূর্তে সঠিক ব্যক্তি' হিসেবে আখ্যা দেন তিনি।

ট্রাম্প সাংবাদিকদের আরও বলেন, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার এই শান্তি চুক্তিসহ মোট আটটি যুদ্ধ থামিয়েছেন তিনি।

এ সময় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ চলার খবর শোনার কথাও বলেন তিনি।

'আমি বলেছি, আগে আমি ফিরে আসি। আমি আরও একটি (যুদ্ধের) সমাধান করতে যাচ্ছি; কারণ আমি যুদ্ধ থামাতে পারদর্শী। আমি শান্তি প্রতিষ্ঠায় দক্ষ। আর এটা করতে পারা সম্মানের। আমি লাখ লাখ জীবন বাঁচিয়েছি—লাখ লাখ জীবন,' বলেন তিনি।

ইসরায়েলি জিম্মি ও ফিলিস্তিনি বন্দীদের প্রত্যাশিত মুক্তির আগে রোববার গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি টানা তৃতীয় দিনের মতো কার্যকর ছিল। এদিনই ইসরায়েলের পার্লামেন্টে ট্রাম্পের ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে।

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গত দুই মাস ধরে ইসরায়েলি হামলার কেন্দ্রে থাকা উত্তরের গাজা সিটির দিকে ফিরতে শুরু করেছে। তাদের আশা, এই যুদ্ধবিরতি শেষপর্যন্ত যুদ্ধের অবসান ঘটাবে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক টেলিভিশন বিবৃতিতে বলেন, 'আগামীকাল একটি নতুন পথের শুরু। একটি বিনির্মাণের পথ, একটি নিরাময়ের পথ।'
এই আশাবাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

গাজার বাসিন্দা আব্দু আবু সিয়াদা রয়টার্সকে বলেন, 'মানুষের মধ্যে অনেক আনন্দ।' তবে দুই বছরের যুদ্ধে গাজার বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এই আনন্দের সঙ্গে ক্লান্তিও মিশে আছে বলে জানান তিনি।

সরকারি মুখপাত্র সশ বেড্রোসিয়ান বলেন, ইসরায়েল আশা করছে সোমবার ভোর থেকে জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া শুরু হবে এবং জীবিত ২০ জন জিম্মিকে একসঙ্গেই মুক্তি দেওয়া হবে। জীবিতদের মুক্তির পর বাকি ২৮ জন মৃত জিম্মির দেহ হস্তান্তর করা হবে।

যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, হামাসের পক্ষ থেকে সোমবার দুপুরের মধ্যে বাকি জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার কথা।

ইসরায়েলের জিম্মি সমন্বয়কারী গাল হির্শ বৃহস্পতিবার বলেলেন, হামাস যেসব মৃত জিম্মির দেহাবশেষ খুঁজে বের করতে পারেনি, তাদের খুঁজে বের করতে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হবে।

ট্রাম্প সোমবার ইসরায়েলে পৌঁছানোর পর দেশটির পার্লামেন্ট নেসেটে ভাষণ দেবেন। এরপর তিনি গাজা যুদ্ধের অবসানে বিশ্বনেতাদের একটি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে মিশরের শারম আল শেখে যাবেন।

রোববার একজন সিনিয়র ফিলিস্তিনি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে অ্যাক্সিওসের এক প্রতিবেদক জানান, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও এই সম্মেলনে যোগ দেবেন।

শনিবার তেল আবিবের এক সমাবেশে ভাষণ দেন ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ ও জ্যারেড কাশনার। অনেক ইসরায়েলির আশা ছিল, জিম্মিদের মুক্তি ও যুদ্ধের অবসানের দাবিতে এটিই হবে শেষ সমাবেশ।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিশর, কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি ও বন্দী বিনিময়ের এই প্রথম ধাপের চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।

ইসরায়েলের কারা পরিষেবা জানিয়েছে, প্রত্যাশিত মুক্তির আগে তারা কিছু ফিলিস্তিনি বন্দীকে অন্য কারাগারে স্থানান্তর করেছে। ইসরায়েলের বিচার মন্ত্রণালয় হত্যাসহ অন্যান্য গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ২৫০ জন ফিলিস্তিনির নাম প্রকাশ করেছে, যাদের এই চুক্তির আওতায় মুক্তি দেওয়া হবে।

এই তালিকায় হামাসের সিনিয়র কমান্ডার বা মারওয়ান আল বারগুতি ও আহমেদ সাদাতের মতো অন্য জনপ্রিয় নেতাদের নাম নেই, যাদের মুক্তির দাবি করেছিল হামাস।

এতে চুক্তি বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে না করা হলেও হামাসের বন্দী তথ্য কার্যালয় জানিয়েছে, মুক্তি পেতে যাওয়া বন্দীদের তালিকা নিয়ে ইসরায়েলি মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় আটক করা আরও ১ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে ইসরায়েল। এছাড়াও ২২ জন ফিলিস্তিনি কিশোর ও ৩৬০ জন যোদ্ধার মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে। ইসরায়েল সরকারের মুখপাত্র বেড্রোসিয়ান বলেছেন, জীবিত জিম্মিরা ইসরায়েলি ভূখণ্ডে পৌঁছানোর পরেই এই বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেছেন, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার পর সেনাবাহিনী গাজায় হামাসের তৈরি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গগুলো ধ্বংস করে দেবে।

উত্তর গাজায় ফিরে আসা ফিলিস্তিনিরা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দিয়েছেন। উদ্ধারকর্মীরা সতর্ক করেছেন, ওই এলাকায় অবিস্ফোরিত গোলা ও বোমা থাকতে পারে।

সাহায্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়কারী একটি ফিলিস্তিনি সংস্থার প্রধান আমজাদ আল শাওয়া ধারণা করেন, বাস্তুচ্যুত ১৫ লাখ গাজাবাসীর জন্য অস্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ৩ লাখ তাঁবুর প্রয়োজন।

৩৭ বছর বয়সী রামি মোহাম্মদ-আলি দেইর আল বালাহ থেকে তার ছেলের সঙ্গে ১৫ কিলোমিটার হেঁটে গাজা সিটিতে ফিরে টেলিফোনে বলেন, 'যে ধ্বংসযজ্ঞ আমরা দেখেছি, তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।'

তিনি বলেন, 'আমরা গাজা সিটিতে ফিরে আনন্দিত, কিন্তু একইসাথে এই ধ্বংসযজ্ঞ দেখে আমাদের মন তিক্ততায় ভরে গেছে।' তিনি জানান, রাস্তার ধারে মানুষের দেহাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখেছেন।

আইকে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বুলেট দিয়ে বিএনপির প্রার্থী সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চান: ডা. শফিকুর রহমান Nov 28, 2025
img
সবাই মিলেমিশে আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তুলব: সেলিমুজ্জামান Nov 28, 2025
img
জোড়া সিনেমায় জুটি বাঁধছেন অপু বিশ্বাস-আদর আজাদ! Nov 28, 2025
img

অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপ

৩ দশকের বেশি অপেক্ষার পর বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল Nov 28, 2025
img
ইন্টারপোলের নতুন নির্বাচিত সভাপতি ফ্রান্সের লুকাস ফিলিপ Nov 28, 2025
img
ভারত সফরে আরও একটি শহরে মেসিকে দেখার প্রস্তুতি Nov 28, 2025
img
পাকিস্তানিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে আরব আমিরাত Nov 28, 2025
img
ধামরাইয়ে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আগুন Nov 28, 2025
img
কন্যা সন্তানের বাবা হলেন অভিনেতা নিলয় আলমগীর Nov 28, 2025
img
কিংবদন্তি গিটারিস্ট ও সংগীত পরিচালক সেলিম হায়দার আর নেই Nov 28, 2025
img
তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়নে ধানের শীষে ভোট চাই: লুৎফর রহমান মতিন Nov 28, 2025
img
মিস ইন্টারন্যাশনাল সেরার মুকুট জিতলেন কলোম্বিয়ার কাতালিনা Nov 28, 2025
img
শাহজাহান চৌধুরীর কথাগুলো ঔদ্ধত্য, অজ্ঞতা, না কি মূর্খতা- প্রশ্ন মাসুদ কামালের Nov 28, 2025
img
টাঙ্গাইল-৮ আসনে ২ শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মীর পদত্যাগ Nov 28, 2025
img
জামায়াতের প্রার্থীর প্রচারণায় বিএনপি সমর্থকদের হামলার নিন্দা-প্রতিবাদ Nov 28, 2025
img
ফজলুর রহমানের বাসার সামনে হাতবোমা নিক্ষেপ নিয়ে আইনজীবী পান্নার মন্তব্য Nov 28, 2025
img
দেশজুড়ে ভবন ও নির্মাণ কাজ অনুমোদনের জন্য পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশ Nov 28, 2025
img
তৃতীয় মেয়াদে ডা. শফিকুর রহমান, দায়িত্ব পালনের নতুন শপথ আজ Nov 28, 2025
img
প্রচারের ভিড়ে নিজস্ব বিশ্বাসে কোয়েল মল্লিক Nov 28, 2025
img
যত ইচ্ছে সমালোচনা করতে বললেন তাওহীদ হৃদয় Nov 28, 2025