বাংলাদেশে এখন সবকিছু গডফাদার কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আপনি সমাজে কতটা প্রভাবশালী এটা নির্ভর করবে আপনার মাথার ওপর কার ছায়া আছে। কার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভালো এবং আত্মীয়তা আছে। এ যুগে শুধু নিজস্ব জ্ঞান, প্রযুক্তি, যোগ্যতা বা শিক্ষার ওপর কোনো কিছুই নির্ভর করে না।
হতে পারেন আপনি বড় একজন ডিসি, ডাজ নট ম্যাটার। দল করেন কোনটা? এভাবে রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুর মধ্যে কুপ্রথা চালু হয়েছে। ফলে এখন ২০২৫ সনের অক্টোবর, এই মাসটি আমাদের জন্য একটি জঘন্য সময় হয়ে পড়েছে।
নিজের ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া ভিডিওতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি এসব কথা বলেন।
ভিডিওতে তিনি বলেন, একটা সময় আমাদের দেশে অনেক লোককে সিআই-এর এজেন্ট বলা হতো। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেন বা তার পর্যায়ের নেতাদের মনে করা হতো আমেরিকার এজেন্ট। সিআইএ এজেন্ট হিসেবে তারা পাকিস্তানকে বা পূর্ববঙ্গকে আমেরিকার হাতে তুলে দিচ্ছে। এর বাইরে আরেকটি গ্রুপ হয়ে গেল কেজিবির এজেন্ট।
বাংলাদেশে বিশেষ করে বামপন্থী রাজনীতি যারা করতেন, তারা কেবিজেবি এজেন্ট। তারা রাশিয়াতে যেতেন। আবার বামপন্থীদের মধ্যে একটা হলো পিকিংপন্থী। পিকিংপন্থী এক দল কমিউনিস্ট ছিল এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীকেও পিকিংপন্থী রাজনীতিবিধি হিসেবে মনে করা হতো। বঙ্গবন্ধুকে মনে করা হতো ভারতের দালাল।
তিনি বলেন, তখন আওয়ামী লীগ, বাকশাল, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন এরা সবাই দিল্লির লোক। তাদের প্রতিপক্ষ যারা আছে, তারা সবাই পাকিস্তানের লোক। রাজাগার, আল বদর, আশশামস, মুসলিম লীগ বলতেই তখন পাকিস্তান এবং ভারত। ৭০-এর দশকে আমেরিকার দালাল বা রাশিয়ার দালাল, এগুলো খুব কম আলোচিত হতো। কিন্তু ৮০-এর দশকে যখন এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় আসলেন, তখন কেন জানি ভারতের বিষয়টি পেছনে চলে গেল। পাকিস্তানের বিষয়টিও পিছনে চলে গেল। সামনে চলে আসলো এক চেটিয়া ভাবে আমেরিকা। ওই সময়টিতে যারা নিজেদেরকে সিআই এর এজেন্ট পরিচয় দিতেন, আমেরিকার দালাল পরিচয় দিতেন সমাজে তাদের মান সম্মান বেড়ে যেত।
রনি বলেন, এরশাদ সাহেব সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতেন এবং তার চমৎকার সম্পর্ক ছিল মূলত ভারতের সঙ্গে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পরেও আমেরিকার দালাল রূপে বা আমেরিকার বন্ধুর রূপে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় যে নৈপূর্ণ দেখিয়েছেন এবং যেভাবে তিনি হোয়াইট হাউজে সম্মানিত হয়েছেন, পুরো আমেরিকার যে বলয়টিকে বাংলাদেশের পক্ষে রেখেছেন এটা স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় কেউ পারেনি। কোনো আমেরিকার লোক পারেনি। অন্যদিকে খুব অল্প সময় পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি মূলত সবার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।
তিনি আরো বলেন, কিন্তু সৌদি আরব এবং চীন, এই দুটো রাষ্ট্র ছাড়া কৌশলগতভাবে আসলে তার সঙ্গে কারোরই সম্পর্ক হয়নি। আওয়ামী লীগের লোক যাই বলুক না কেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেবের সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো কালে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি যখন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন পেলেন বা জেন্টলম্যান ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান আর্মিতে ঢুকলেন, ঠিক তখন থেকে তিনি পূর্ববঙ্গকে নিয়ে চিন্তা করতেন। স্বতন্ত্র একটা রাষ্ট্রকে নিয়ে চিন্তা করতেন এবং পাকিস্তানের কোনো কিছুকে তিনি পছন্দ করতেন না। এই ধ্রুব সত্যটি আওয়ামী লীগ যতদিন পর্যন্ত মানতে না পারবে এবং বিএনপি যতদিন পর্যন্ত এই জিনিসটা হৃদয়াঙ্গম করতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতি শক্তিশালী হবে না।
তিনি আরো বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এরশাদ সাহেব আসলেন। এরশাদ সাহেব মূলত কৌশলী। তার সংস্পর্শে যে সকল রাজনীতিবিদ সাহিত্যিক, সাংবাদিক যেতেন সবাই তার সরলতায় মুগ্ধ হতো। সেই সরলতাটাকে কাজে লাগিয়ে কাউকে প্রতাারিত করেননি বটে কিন্তু নিজের স্বার্থ এবং নিজের সিদ্ধান্ত সময়মত নিয়ে নিয়েছেন। ফলে নয়টি বছর তিনি শাসন কার্য পরিচালনা করেছেন। তার বন্ধুত্ব সৌদি আরবের, চীনের, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আমেরিকা, পাকিস্তান, ভারতসহ সবার সঙ্গে। তিনি যে সমতার নীতি অবলম্বন করেছিলেন, এটা বাংলাদেশে অন্য কোন রাজনীতিবিদ পারেন নাই।
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান, পরবর্তী খালেদা জিয়ার সরকার তারা সবার কাছ থেকে অবারিত সুযোগ পেয়েছে। তারা সৌদি আরব, চীন, পাকিস্তান থেকে সুযোগ পেয়েছে। এমনকি ভারত থেকেও পেয়েছে। কিন্তু কোনো একটি সম্পর্ককে তারা ম্যাটোরালাইজ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে কিন্তু ভারত, ইমরান খান, কাতার, সৌদি আরব, মোহাম্মদ বিন সালমান, আমেরিকা, হিলারি ক্লিন্টন, জো বাইডেন, জন ক্যারি, বারাক ওবামা, বিল ক্লিন্টন, ড. ইউনূস সবাই বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে। কেউ শত্রুতা করতে চায়নি। দুর্ভাগ্য আওয়ামী লীগ কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেনি। নট ইভেন ভারত। আওয়ামী লীগের কোনো অপশন নেই ভারত ছাড়া। ভারতের কোনো অপশন নেই আওয়ামী লীগ ছাড়া। এজন্য তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক হচ্ছে।
রনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জমানা থেকে আজ অবধি ভারতের সঙ্গে কখনো কোনো আন্তরিকতা ছিল না। এর পুরোটাই একে অপরকে ব্যবহার করার, একে অপরের নিকট থেকে স্বার্থ হাসিল করার একটা উদ্দেশ্য ছিল। এভাবে কিন্তু আমাদের পুরো পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি এই যে দেশগুলোর সঙ্গে সেইভাবে চলছে। পাকিস্তানের কৌশলগত অনেকগুলো বন্ধু রয়েছে। যেমন সৌদি আরাবিয়া, চীন, আমেরিকা। ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে রাশিয়ার। কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে সৌদি আরবের। কৌশলগত সম্পর্ক আছে ইসরাইলের। এরকম কোন সম্পর্ক আমাদের কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে নেই।
তিনি বলেন, এখন হাজার হাজার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ভারতে আছে। মানে আওয়ামী লীগের মাথার ওপর ভারত আছে। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে তারা ভারত যেতে পারবে। এরকম একটা ন্যারেটিভ আছে এবং ভারত আওয়ামী লীগের মুরুব্বি, এটা আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। দ্বিতীয় যে বিষয়টি রয়েছে সেটা হলো, জামাত জামাতের সঙ্গে পাকিস্তানের একটা ভালো সম্পর্ক আছে, এতে কোন অস্বীকার করার কিছুই নেই। তুরস্কের সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক আছে। জামাতের মাথার ওপরে পাকিস্তান আছে, তুরস্ক আছে, এখন শক্তিশালী ড. মোহাম্মদ ইউনূস আছে, তার সঙ্গে ইউরোপ আছে, তার সঙ্গে আমেরিকার আছে। বিএনপির সঙ্গে কে আছে, তারেক রহমানের সাথে কে আছে? তারেক রহমান সাহেবের সাথে কি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কোন সম্পর্ক আছে? বিএনপির সঙ্গে কি পাকিস্তানের যে বর্তমান সেনাপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী, তাদের কারো সঙ্গে বিএনপির কোনো নেতার সম্পর্ক আছে?
তিনি আরো বলেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে ম্যাখোঁর একটা সম্পর্ক রয়েছে আর মোদির কথা তো বললামই। অন্যদিকে শেখ হাসিনার সঙ্গে পারিবারিকভাবে ভুট্ট পরিবারের একটা সম্পর্ক রয়েছে। অবাক করা ব্যাপার হলো, বেনজির ভুট্ট, আসিফ আলী জারদারি, বেলালোয়াল ভুট্ট, নুসরাত ভুট্ট তাদের সবার সঙ্গে শেখ হাসিনার একটা অন্তরঙ্গ পারিবারিক সম্পর্ক আছে বা ছিল। গান্ধী পরিবারের সঙ্গেও শেখ হাসিনার পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। তো সেই দিক থেকে রাজনীতির অন্দর মহলে ঢুকে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের বিকল্প কি? জয়ের যে স্ত্রী ছিলেন বা আছেন আমি জানিনা তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে কি না, তিনি মিশিগানের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটদের যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, এ রকম সম্পর্ক কি বিএনপির রিপাবলিকানদের সঙ্গে আছে? কিন্তু আওয়ামী লীগের আছে। জামাতের আছে।
রনি বলেন, শেখ রেহানা ছেলে ববি। ববি ফিনল্যান্ডের অত্যন্ত অভিজাত একটি পরিবারে বিয়ে করেছেন। তার শ্বশুর ওখানকার মন্ত্রী ছিলেন। সেই দিক থেকে ড. মোহাম্মদ ইউনূস বলেন, শেখ হাসিনা বলেন, জামাত বলেন, সবারই মাথার ওপর ছায়া আছে। এটাকে আপনি গডফাদার বলেন, তাবেদার বলেন, যা কিছু বলেন না কেন সেটা তাদের আছে। বিএনপির কারা আছে? মাঝে মধ্যে আমরা দেখি, সামা ওবায়েত আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে বৈঠক করেন। মাঝে মধ্যে আমরা দেখি, ড. মঈন খান তার বাসায় কয়েকজন রাষ্ট্রদূতকে দাওয়াত করেন এবং তাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন। সেগুলা বিএনপির পেইজে প্রকাশিত হয়। ফরেন রিলেশন রিলেশনস কমিটি এরকম একটা টিম আছে। তারা এই রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেন এবং আলতাফ হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে বিএনপির কয়েকজন লোকজন আছেন, তারা মাঝেমধ্যে চীনের একটা পলিটিক্যাল গ্রুপের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো তাই মাঝে মাঝে তারা চীন ভ্রমণে যান। এইতো বিএনপির।
তিনি বলেন, সেই দিক থেকে জনাব তারেক রহমান সাহেবের সেই পর্যায়ের আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটি লাগবে। গডফাদার লাগবে। মাথার ওপর ছায়া লাগবে, যা কি না বিএনপির প্রতিপক্ষের জন্য, তারেক রহমানের প্রতিপক্ষের জন্য রীতিমত একটা প্রেশার হিসেবে কাজ করবে। অনেক যোগ্য মানুষ আওয়ামী লীগ থেকে এসে বিএনপির হাল ধরেছে। বিএনপি থেকে কোনো লোক কিন্তু আওয়ামী লীগে ঢুকতেই পারেনি। আওয়ামী লীগের দরজা এভাবে বন্ধ। কাজেই এখানে আসলে পলিসিগতভাবে প্রতিপক্ষের যে জিনিসগুলো রয়েছে, সেই জিনিসগুলো যদি আপনার না থাকে তাহলে আপনি কি করে তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করবেন?
যেখানে জামায়েতের আমির ঘুরে বেড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা প্রতিটি মুহূর্তে কথা দিয়ে কর্ম দিয়ে সবাইকে তছনচ করে দিচ্ছে, আর সেখানে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে লোক আগামীতে নমিনেশন পাওয়ার জন্য লন্ডনে যাচ্ছে। এমন লোকও লন্ডনে যাচ্ছে, যে নমিনেশন তো দূরের কথা কোনো একটা এলাকাতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচন করার যোগ্যতা রাখে না। একবারও ভাবছে না যে, রাজনীতিটা কি হবে? নেতা কেমন আছে? তার কি প্রয়োজন দেশে, কি প্রয়োজন দলের জন্য? তাহলে বাকি যারা রইলো, তারা কি রাজনীতি করবে? আপনার কি মনে হয় না সব এলোমেলো হয়ে গেছে?
কেএন/এসএন