নারী, দখল, চাঁদাবাজি : ক্ষমতাবান হারুনের যত কেলেঙ্কারি

নারী কেলেঙ্কারি, অন্যের সম্পদ দখল এবং চাঁদাবাজিই ছিল হারুনের প্রধান কাজ। পুলিশের পোশাকে তিনি ছিলেন মাফিয়া। ডিবিপ্রধান হওয়ার পর হারুন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান। চরম স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করেন।

ডিবি অফিসকে বানিয়ে ফেলেন হেরেম। শোবিজের তারকাদের নিয়ে যাওয়া হতো ডিবি অফিসে। সেখানে চলত নোংরামি। ধর্ষক, লুটেরা এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা ছিল তার ঘনিষ্ঠজন।

অবৈধ লুটের লাখ লাখ টাকা হারুন ওড়াতেন শোবিজের তারকাদের পেছনে। হারুনের ঘনিষ্ঠ দুই সাপ্লাইয়ার ছিলেন গান বাংলার তাপস এবং কনটেন্ট নির্মাতা তৌহিদ আফ্রিদি। এদের কাজ ছিল সুন্দরী মেয়েদের হারুনের কাছে নিয়ে আসা। গভীর রাতে ডিবি অফিস হয়ে যেত রঙ্গশালা।

নারী আর মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন হারুন। তৌহিদ আফ্রিদি এবং তাপস হারুনের প্রশ্রয়ে হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। হারুনের মদদে তাপস গান বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল দখল করেন।

তাপসের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না হারুনের জন্য। তৌহিদ আফ্রিদিও যা খুশি করার সুযোগ পান হারুনের কারণে।

আফ্রিদি হারুনকে আংকেল বলে সম্বোধন করতেন। হারুনের সাপ্লাইয়ার হওয়ার কারণে তার সব অপরাধ বিচারের বাইরে থেকে যেত। মুনিয়া নামের একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেমের নাটক করেন তৌহিদ আফ্রিদি। তার পর তাঁকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। পুরো ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া হয় হারুনের তত্ত্বাবধানে। তৌহিদ আফ্রিদিকে বাঁচাতে মুনিয়া হত্যাকা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়।

দেশের একজন বিশিষ্ট তরুণ শিল্পোদ্যোক্তাকে জড়িয়ে কুরুচিপূর্ণ মিথ্যাচার করে প্রকৃত সত্য আড়াল করার চেষ্টা করা হয়। তবে ৫ আগস্টের পর তৌহিদ আফ্রিদি গ্রেপ্তার হওয়ার পর আসল সত্য বেরিয়ে এসেছে। এভাবেই হারুন অপরাধীর রক্ষক হয়ে উঠেছিলেন। নারী কেলেঙ্কারি ছাড়াও চাঁদাবাজি, দখলবাজির শতাধিক অভিযোগ আছে হারুনের বিরুদ্ধে।

চাঁদার জন্য তিনি একাধিক শিল্পপতিকে তুলে নিয়ে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তারের ভয় দেখাতেন। এর ধারাবাহিকতায় চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেলের স্ত্রী-সন্তানকে রাজধানীর গুলশানের বাসা থেকে এসপি হারুন একদল পুলিশ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে তুলে নিয়ে যান। পরে তারা মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। এ ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হলে ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর এসপি হারুনকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে (ট্রেনিং রিজার্ভ) সংযুক্ত করা হয়।

নারায়ণগঞ্জে যোগ দেওয়ার আগে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হারুন অর রশীদ। টানা চার বছর এ জেলায় দায়িত্ব পালনের সময় তার বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ ওঠে। ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের জিম্মি করে টাকা আদায়, জমি দখলে সহায়তা ও মদত দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

২০১৮ সালে মাওনার নয়নপুর বাজারে প্রায় ২১ শতাংশ জমির ওপর একটি মার্কেট দখলে এসপি হারুন সহযোগিতা করেন। বিনিময়ে তিনি নেন বড় অঙ্কের টাকা। এমন অভিযোগ করেছেন ওই মার্কেটের মালিক আমিনুল হাজি। তিনি বলেন, আমাদের তিন ভাইয়ের নামে ওই মার্কেটটি ছিল। প্রায় ৫০ বছর আগে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৪৪ শতাংশ জমি কিনেছিলেন আমাদের বাবা।

পরে সরকার এই জমির ২৩ শতাংশ নিয়ে যায়। বাকি ২১ শতাংশ জমির ওপরই মার্কেটটি ছিল। কিন্তু জমির আগের মালিকের ছেলে আমির হোসেন এসপি হারুন ও ডিবির সহযোগিতায় মার্কেটটি দখলে নিয়ে যায়।

অথচ জমির সবকিছু ঠিক ছিল। একদিন গভীর রাতে পুলিশ ও ডিবি সদস্যদের উপস্থিতিতে বুলডোজার দিয়ে মার্কেটটি ভেঙে তারা দখলে নেয়। এর আগে জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য ডিবি আমাদের বাড়িতে গিয়ে খারাপ আচরণ করেছিল। তারা আমাদের অনেক ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়েছিল। এরপর এসপি অফিসে গিয়ে ডিবির ওসি আমির হোসেনের কাছে আমরা ঘটনা বুঝিয়ে বলি। কিন্তু তিনিও আমাদের সহযোগিতা না করে উল্টো মার্কেটটি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন।

চার বছর আগে ১০০ কোটি টাকা মূল্যের একটি জমি জোর করে রেজিস্ট্রি করতে আর্থিক সুবিধা নিয়ে সহযোগিতা করেছেন এসপি হারুন- এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে জেলা যুগ্ম জজ আদালতে মামলাও হয়েছিল। ২০১৬ সালের ১০ মে ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দা এ মামলা করেন। পরে এসপি হারুন আদালতে মুচলেকা দিয়ে জামিন নেন।

হারুনের হয়ানির শিকার হয়েছিলেন শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতা মো. মাহতাব উদ্দিন। সাবেক এমপি ইকবাল হোসেন সবুজের রাজনৈতিক সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করায় তখন তাকে হয়রানি করা হয়। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মাদক মামলাও দেওয়া হয়েছিল। এর নেপথ্যে ছিলেন সাবেক একজন এমপিপুত্র।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল গভীর রাতে মাওনা চৌরাস্তার পাশে মাহতাব উদ্দিনের বাড়িতে ডিবি পুলিশ গিয়ে হানা দেয়। তখন তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন তার নামে কোনো মামলা আছে কি না বা কেনইবা তাকে নেওয়া হবে। তখন ডিবির এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, এসপি হারুন নিয়ে যেতে বলেছেন। এরপর ডিবির সদস্যরা গাজীপুর নেওয়ার উদ্দেশে একটি মাইক্রো বাসে ওঠায় তাকে।

কিন্তু তারা গাজীপুরের রাস্তায় না নিয়ে মাওনা চৌরাস্তা ঘুরিয়ে অন্যদিকে জেলা ডিবি অফিসে নিয়ে একটি রুমে রাখে। পরের দিন সকালে একটি কালো মাইক্রোতে তুলে শহরের বাইরে নির্জন একটি এলাকায় নিয়ে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখে। বিকালে মাহতাব উদ্দিনকে কোর্টের গারদখানায় নেওয়া হয়। গারদখানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা ডিবির কাছে মামলার ফরোয়ার্ডিং চান। তখন ডিবি সদস্যরা বলেন, উনার নামে কোনো মামলা নেই, মামলা আসছে। স্যার আপনাদের কাছে রাখার জন্য বলছেন। তখন ফরোয়ার্ডিং ছাড়া তাকে রাখতে রাজি হননি ওই কর্মকর্তা। পরে ডিবি সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে ওই কর্মকর্তার কথা বলান। এরপর মাহতাব উদ্দিনকে নিয়ে ওই কর্মকর্তা তার কক্ষে রাখেন। এরপর বিকাল বেলা তাকে মাদক মামলায় আদালতে হাজির করা হয়।

মাহতাব উদ্দিন বলেন, আমার সঙ্গে নাকি ২০০ পিস ইয়াবা আছে এমন মিথ্যা অভিযোগে মামলা দিয়ে ২৪ দিন জেল খাটায়। একদম বিনা অপরাধে আমাকে তারা এ হয়রানি করেছে।

মাহবুব হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে জিম্মি করে টাকা আদায় করেন হারুন। নানারকম ভয়ভীতি দেখিয়ে ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা আদায় ও অমানবিক নির্যাতন করেন। এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী মাহবুব হোসেন নিজেই। তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার শফিকুর বাজারের সাবেক ব্যবসায়ী নেতা। ভয়াল ওই রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাকে মোবাইল ফোনে ডিবি অফিসের লোক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চায় এক ব্যক্তি। আমি তাদের আমার ঠিকানা দিই। ঠিকানা মতো এসে তারা আমাকে বলে এসপি স্যারের (হারুন অর রশীদ) নির্দেশ আপনাকে গাজীপুর যেতে হবে।

তখন তারা আমাকে একটি গাড়িতে তুলে মৌচাক পার হওয়ার পর পেছনে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে। টের পেয়েছি আমি ছাড়াও বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও কয়েকজনকে আটক করেছিল। তার পর আমাকে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরাতে থাকে। একপর্যায়ে আমাকে গাড়ির মধ্যেই নির্যাতন শুরু করে। বেধড়ক পেটাতে পেটাতে আমাকে তারা বলে আপনার কোনো লোক নেই। থাকলে আলোচনা করেন। না হলে কালেমা পড়েন। আপনাকে রক্ষা করতে পারব না আমরা, মেরে ফেলব। একটা উপায় আছে- ২ কোটি টাকা দিলে রক্ষা করতে পারব।

তখন গভীর রাতে আমার ভাইকে ফোন দিয়ে বলি আমাকে ধরে নিয়ে আসছে। এখন তারা টাকা চায়, পারলে টাকার ব্যবস্থা করে আমাকে বাঁচা। এরপর তারা আমাকে নিয়ে যায় কড্ডা।

সেখানে গিয়ে দেখি ইন্সপেক্টর বাচ্চু। তিনিও আমাকে খুব মারধর করেন। তার পর সেখান থেকে নিয়ে যায় এসপি হারুনের ঘনিষ্ঠ জসিমের বাড়িতে।

ততক্ষণে তারা আমার ভাইয়ের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা নিয়ে গেছে। আমার কাছে ছিল নগদ ৭০ হাজার টাকা এবং ২০ লাখ ও সাড়ে ১৮ লাখ টাকার দুটি চেক। সেগুলো তারা নিয়ে বলে পরের দিন সকালে আরও টাকা দিতে হবে। এ ছাড়া পুলিশের সামনেই জসিম বলে ১০ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে হবে। আমি দিতে রাজি না হলে তারা আমাকে ভয়ভীতি দেখায়। পরে চার শতাংশ জমি দেওয়ার কথা বলে আমাকে ছেড়ে দেয়।

পরের দিন অস্ত্রসহ ১০-১২ জন পুলিশ ও জসিম আমার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। আমার কাছ থেকে নেওয়া চেক দিয়ে টাকা তুলে দিতে বলে। এভাবে দুটি চেকের মাধ্যমে আমি সাড়ে ৩৮ লাখ টাকা তুলে দিই। এর ঠিক কয়েক দিন পর তারা অস্ত্রের মুখে আমার মেয়ে ও আমাকে তুলে নিয়ে চার শতক জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়ে যায়। সব মিলিয়ে তারা আমার কাছ বিভিন্ন সময় ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা নিয়ে গেছে। আর সবকিছু এসপি হারুনের নির্দেশে তারই ঘনিষ্ঠদের দিয়ে করানো হয়েছে। এরকম বহু অপরাধের পরও হারুন চাকরি করেন বহাল তবিয়তে। কারণ, তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের মাফিয়া। বিচারের ঊর্ধ্বে।

এমকে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ওপেনএআই'র অ্যাপ সাজেশন নিয়ে বিতর্ক Dec 08, 2025
img
অস্ট্রেলিয়ার চূড়ান্ত স্কোয়াডে ‘বাংলাদেশি’ ফুটবলার Dec 08, 2025
img
ড্রোন হামলায় চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রের ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত’: জাতিসংঘ Dec 08, 2025
img

আদালত অবমাননার অভিযোগ

নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে অব্যাহতি পেলেন বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান Dec 08, 2025
img
মালদ্বীপের পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের সাক্ষাৎ Dec 08, 2025
img
সিইসির সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধি দল Dec 08, 2025
img
আজ ৮ ডিসেম্বর ঝালকাঠি হানাদারমুক্ত দিবস Dec 08, 2025
img
সারা দেশে রাত-দিনে তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে Dec 08, 2025
img
গণতান্ত্রিক যাত্রায় যারাই বাধার সৃষ্টি করবে, তাদের প্রত্যাখ্যান করবে জনগণ: সালাহউদ্দিন Dec 08, 2025
img
ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানাতে ফোন করলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো Dec 08, 2025
img
জামায়াত আমিরের সঙ্গে ব্রুনাইয়ের হাইকমিশনারের সাক্ষাৎ Dec 08, 2025
img
দেবকে চিনতেন না রুক্মিণীর বাবা Dec 08, 2025
img
ব্যাংক খাতের রাজনৈতিক অঙ্গনের স্বেচ্ছাচারিতা কারো অজানা নয় : জিল্লুর রহমান Dec 08, 2025
img

জুলাই আগস্ট হত্যাযজ্ঞ

ওবায়দুল কাদের ও যুবলীগ সভাপতিসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ Dec 08, 2025
img
আইনজীবীদের বহর নিয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান Dec 08, 2025
img
ইউরোপজুড়ে অভিবাসন বিতর্কে ইতালি এখন কেন্দ্রে Dec 08, 2025
img
পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি আজ Dec 08, 2025
img
মালদ্বীপে বিশেষ অভিযানে ১৮ বিদেশি আটক Dec 08, 2025
img
আইইএলটিএস-এ ভুল ফলাফল ৮০ হাজার শিক্ষার্থীর, বাংলাদেশে প্রশ্নফাঁস Dec 08, 2025
img
শীতকালে পিরিয়ডে কোন ফলগুলো এড়িয়ে চলবেন Dec 08, 2025