গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘এই সরকারের (অন্তর্বর্তী সরকার) ওপর আমরা তিনটি দলের প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর আওয়াজ বেশি এবং তাদের কর্তৃত্ব বেশি দেখা যাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর যে দাপট, সেটা তারা বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করতে চায়।’
তিনি অভিযোগ করেন, সুফি-সাধক, মাজার ও দরবারে হামলা, নারীর চলাফেরায় আক্রমণ এবং ভিন্নমতের মানুষের ওপর হামলাকারী ‘মব সন্ত্রাসীদের’ সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) রাজধানীর বিএমএ ভবনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কনভেনশনের সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এ সময় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘৫ আগস্ট একটা গণ অভ্যুত্থান হয়েছে, যেটাতে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছে। বহু বছরের ক্ষোভ, অত্যাচার, শোষণে মানুষ ভয়ংকর রকম ক্ষুব্ধ ছিল। সব স্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে শেখ হাসিনাকে তাড়িয়েছে। এ তাড়ানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের একটা স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল। সে স্বপ্ন দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে আছে।’
তিনি বলেন, ‘এ পরিবর্তনের ফলে কিছু গোষ্ঠী যারা ছদ্মবেশে ছিল, যারা গোপনে ছিল, যারা আগে এক রকম পরিচয় দিত, পরে অন্য রকম পরিচয়ে হাজির হয়েছে, যারা আগে একধরনের সাংগঠনিক পরিচয় দিত, এখন অন্য রকম পরিচয় দেয় এবং একটা প্রতারণার মধ্য দিয়ে যাদের বিকাশ বা যাদের শক্তি, তারা হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়ে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করল, যেখানে আরও বেশি বৈষম্য, আরও বেশি আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ধর্মীয়, লৈঙ্গিক ও জাতিগত পরিচয়ের কারণে আরও বেশি আতঙ্কের মধ্যে পড়ছে মানুষ।
এটাকে আওয়ামী লীগ আমলের ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তুলনা করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘যারা আক্রমণ করছে, তাদের কথা হচ্ছে তাদের মতো করে ধর্ম পালন করতে হবে, তাদের মতো করে চিন্তা করতে হবে, তাদের রাজনীতিকে গ্রহণ করতে হবে। এটাকে ফ্যাসিবাদ বলে। আওয়ামী লীগের সময়ে আমরা এটা দেখেছি এবং সেটারই আরেকটা ভয়ংকর চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
এগুলোর বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা না নেওয়ায় সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এই অন্তর্বতী সরকারের দায়িত্ব কী? এগুলোর জন্য তাদের দায়ী করতাম না আমরা। কিন্তু করতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ, যদি দেখতাম সরকার চেষ্টা করছে এগুলো থামানোর জন্য কিংবা এগুলোর বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ যথেষ্ট জোরালো, আমরা দেখলাম তাদের কণ্ঠস্বর জোরালো না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা মব সন্ত্রাসকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে কিংবা যারা এগুলো করছে, তাদেরকে প্রশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা করছে।’
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কনভেনশনকে বাংলাদেশের জন্য একটি সত্যিকার অর্থে প্রতিনিধিত্বমূলক কনভেনশন বলে উল্লেখ করেন আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর যে সমাবেশ হয়েছে কনভেনশনে, সেটাকে আরও ঐক্যবদ্ধ করে একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে, যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বলে আলাদা করে কিছু থাকবে না। বাংলাদেশ সবার সমান সুযোগের দেশ হয়ে উঠবে।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন বলেন, ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কেউ সম্পদের হিসেবে প্রান্তিক, কেউ জাতি হিসেবে, এমনকি নিজ ধর্মের মধ্যেও অনেকে প্রান্তিক। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংকট আরও গভীর হয়েছে গত এক বছরে।’
তিনি বলেন, ‘এখন ওহাবি, মওদুদিবাদীদের শাসন চলছে। হজরত শাহপরান (রহ.)–এর মাজার ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল। একজন মানুষ তার সাধনা, লম্বা চুল রাখে তাতে কার কী সমস্যা? স্বঘোষিত নাপিতদের এ অধিকার কে দিয়েছে? শুধু চিন্তা ও তরিকার পার্থক্য থাকার কারণে কবর থেকে তুলে নুরাল পাগলার লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
সংবিধানে অন্যান্য জাতিসত্তাকে অস্বীকার করা হয়েছে জানিয়ে আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন বলেন, ‘বাংলাদেশকে এক জাতির দেশ যে বলা হয়, সেটা ঠিক না। সংখ্যা দিয়ে জাতি বিচার করা যায় না। জাতিসত্তাগুলোকে রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালন করেনি।’
সুফিবাদ গবেষণা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সুফি মোবারক হোসেন মুরাদ বলেন, ‘৫ আগস্টের পরদিন ৬ আগস্ট থেকে মাজার ভাঙা, ৭ তারিখ থেকে দরবার লুট শুরু হলো। এ জন্য কি গণ-অভ্যুত্থান? কোনো সুফি হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেনি, বেগমপাড়াতে তো বাড়ি করেনি। যারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটেছে, তাদের ধরো। যারা মানবতার কথা বলে, তাদের ওপর আক্রমণ কেন?’
চা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের নেতা সবুজ তাঁতী তাঁদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক জীবন টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়নের নেতা শ্রীকান্ত মাহাতো যার যার এলাকায় সংগঠিত হয়ে আদিবাসীদের জমি, ভিটা দখলদারদের বিরুদ্ধে ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান।বিশ্ব সুফি সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য হাসান শাহ দীপু নুরী সুরেশ্বরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কনভেনশনের শেষ অধিবেশনে হাজং জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি প্রণব হাজং, নাটোর জেলার বড়াইগ্রামের মহাদেব মাহাতো, উত্তরবঙ্গের মুন্ডা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নীতি মুন্ডা, ওঁরাও সম্প্রদায়ের দিপংকর ওঁরাও বক্তব্য দেন।
শুক্রবার সকালে জাতীয় সংগীত ও গণসংগীতের মধ্য দিয়ে কনভেনশন শুরু হয়। দিনব্যাপী এ কনভেনশনে চারটি অধিবেশন ছিল। দেশের ৫৫টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এ কনভেনশনে অংশ নেয়।
এবি/টিকে