‘আমরা মার খাইতে জানি, কাউরে মারতে জানি না’—গ্রেপ্তার বাউল শিল্পী আবুল সরকারের ভক্তদের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানালেন তার সহধর্মিণী ও সহশিল্পী আলেয়া বেগম। পালাগানের আধ্যাত্মিক ধারার অন্যতম এই শিল্পীকে আটক করার পর তাকে একনজর দেখতে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো ভক্ত ছুটে এলেও পথে হামলার শিকার হয়েছেন অনেকে। ঘটনাটিকে গভীর বেদনা ও অন্যায়ের বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘বাউলদের পথ শান্তির, তাদের হাত কখনো কাউকে আঘাতের জন্য ওঠে না।’
রবিবার (২৩ নভেম্বর) আবুল সরকারের সহধর্মিণী ও সহশিল্পী আলেয়া বেগম বলেন, ‘আমাদের বিপক্ষে যে দল বলছে ধর্মে আঘাত করা হয়েছে, তারাই নাকি ধার্মিক! তাহলে তারাই এখন আইসা ফাঁসির দাবি করছে।
তারাই আবার আল্লাহকে নিয়ে আপত্তিকর কথা ছড়াচ্ছে। কারো ক্ষতি চাওয়া আমাদের ধর্মে নেই। আর আমরা কি আল্লাহকে নিয়ে বাজে কথা বলব? আল্লাহর অসন্তুষ্টি ডেকে আনার প্রশ্নই আসে না—এটা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়।’
তিনি আরো বলেন, আবুল সরকারকে গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে রাখা হয়েছে।
তিনি একজন বাউল শিল্পী, বিশেষ করে পালাগানের শিল্পী। পালাগানে যখন দুই পক্ষ থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তর্ক-বিতর্ক ও কথাবার্তা চলে—এভাবেই গান উপস্থাপন করতে হয়। একটি পালা গান সাধারণত ৭–৮ ঘণ্টা চলে; এত দীর্ঘ সময় ধরে গান ও কথোপকথন করতে গিয়ে এক বিষয়ের পর আরেক বিষয়ের প্রসঙ্গ আসতেই পারে। সেই ধারাবাহিকতার মধ্যেই অনেক কথা বলা হয়।
আলেয়া বেগম বলেন, আমাদের অডিয়েন্স—যারা পালা গান শোনেন, যারা দরবারমুখী, পীর-মুর্শিদ, অলি-আউলিয়া, আধ্যাত্মিকতা, দর্শন ও দেহতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন, তারা জানেন- এসব বিষয়ে ‘পরম সত্তা’ ও পরম সত্তার সঙ্গে ‘একত্ব’-এর ধারণা প্রকাশ পায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যখন কেউ বন্ধুর মতো ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়, তখন সেখানে ভয়ের সম্পর্ক থাকে না। বন্ধুর কাছে বন্ধু ভয় পায় না। কখনো কখনো মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগের মতো কথাবার্তা আসতেই পারে, কিন্তু তাতে ভুল কিছু নেই।
তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে, আমার মালিক, আমার আল্লাহ-সবসময় আমার সঙ্গে উপস্থিত।
এক মুহূর্তের জন্য আমি তাকে হারাই না। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় বিষয়। মালিককে আমি সর্বক্ষণ উপস্থিত পাই। আর যাকে আমি এইভাবে ভালোবাসি, সেখানে ভয়ের কোনো প্রশ্নই আসে না। ভয় তো তারাই পায়, যারা অহরহ মালিকের সঙ্গে শিরক করে, বিদআত করে, সবকিছুতে ‘আমার আমার’ বলতে থাকে। আমার বাড়ি, আমার গাড়ি, আমার সম্পদ, ইত্যাদি। যারা সবকিছুকে নিজের বলে দাবি করে, তারাই ভয় পায়। আমি কেন ভয় পাব? আমি তো নিজেকে তাঁর (আল্লাহর) করে দিয়েছি। বাউলের ভাষায়—আমি তাঁর; এখানে ‘আমার’ বলে আমার কিছুই নেই।
তিনি আরো বলেন, ‘‘আবুল সরকার একজন জ্ঞানী বাউল, যিনি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি বাংলাদেশের কথাই বলছি, কারণ বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে বাউল সঙ্গীত গভীরভাবে জড়িত। অনেক মানুষ আছেন যারা বাউল গান, আধ্যাত্মিক গান না শুনলে কোনোভাবেই শান্তি পান না। শান্তি তো শুধু ধন-দৌলত, টাকা-পয়সায় আসে না। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না। আবুল সরকারকে গ্রেপ্তারের পর তিনি আমাকে বলেন ‘এই অবস্থাও তাঁর ইশারা; এটাই আনন্দ, এটাই খুশি, এটাই প্রেম। তাঁর ইচ্ছায় আমি এখানে এসেছি। জেল, কারাগার—সবই তাঁর জায়গা। মালিক কোথাও অনুপস্থিত নন; এখানেও তিনি আছেন’।’’
আলেয়া বেগম বলেন, ১৯ নভেম্বর রাতে আবুল সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়। আজ তাকে আদালতে তোলার কথা। এই খবর শুনে চারদিক থেকে তার ভক্ত–মুরিদ–আশিকানরা ছুটে আসে। আনুমানিক প্রায় ৫০ হাজার মানুষ, পুরো জেলার চারপাশ থেকে। শুধু এই আশায়—‘আজ বাবা জামিন পেতে পারেন, এক নজর দেখার জন্য’। তাদের তো আমি বলতে পারি না—‘এসো না’। সেটা বলা মানে তাদের কষ্ট দ্বিগুণ করা। তাই বললাম—‘আসো বাবা, ভাগ্য থাকলে বাবারে এক নজর দেখতে পাবে।’ কিন্তু আমাদের বিপক্ষে যে দল, যারা দাবি করছে যে ধর্মে আঘাত করা হয়েছে—তারাই নিজেদের ধার্মিক বলে। অথচ তারাই এখন ফাঁসির দাবি করছে। এটা সম্পূর্ণ আপত্তিকর। কারণ কারো ক্ষতি চাওয়া আমাদের চরিত্রে নেই, স্বভাবেও নেই। আমাদের ধর্মেও নেই। আল্লাহকে নিয়ে আমরা কি কখনো বাজে কথা বলতে পারি? আল্লাহর অসন্তুষ্টি ডেকে আনার প্রশ্নই আসে না—এটা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ভক্তরা যখন আসছিল, তাদের চেহারা, বাবড়ি চুল, গলায় গামছা—দেখলেই বোঝা যায় তারা বাউল, বয়াতির দল, বাউলের শিষ্যরা। সেই অবস্থায় তাদের দিকে ধাওয়া করা হয়েছে, অনেককে মারধর করা হয়েছে। কারে মাথা ফাটানো হয়েছে, কাউকে দূরে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে আমাকে ফোন দিয়ে বলা হলো—‘মা, অনেকের মাথা ফেটে গেছে, এখনো রক্ত ঝরছে।’ আমি বললাম, ‘হাসপাতালে ভর্তি করো, আমি আসছি।’ তারপর বুঝিয়ে বললাম—‘থাক বাবা, মাইর খাও।’ কারণ আমি তো স্টেজেই সবসময় বলি, ‘আমরা যারা এই পথে আছি, আমরা মার খেতে জানি, কিন্তু কাউকে মারতে জানি না। আমাদের হাত কখনো কাউকে আঘাত করার জন্য ওঠে না।’
ইএ/টিএ