মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মংডু, রাথিডং ও বুথিডং টাউনশিপের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে আরকান আর্মি (এএ) সেখানকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন সম্প্রদায়ের জন্য নতুন বসতি নির্মাণ করছে। রাখাইনভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘রোহিঙ্গাখবর’-এর এক প্রতিবেদনে এমনটিই উঠে এসেছে।
গত ৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চলে যাওয়ায় জনশূন্য হয়ে পড়া এলাকাগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েছে আরকান আর্মির রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগস অফ আরকান (ইউএলএ)।
গত কয়েক মাস ধরে প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে ‘রাখাইন’ সম্প্রদায়ের লোকজনকে সেখানে নিয়ে আসা হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ রাখাইনদের গ্রামে রূপান্তরিত হওয়া উত্তর মংডুর ৮টি গ্রামের নাম পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো—নওয়ার ইয়োন তাউং, খাওলিজার, কিকানপিন, ওয়াবুত, ফার উত চাউং, মায়াও তাউং এবং কিইন চাউং।
জমি দখল ও নিপীড়নের পাশাপাশি সেখানে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের ‘জোরপূর্বক শ্রমে’ আরকান আর্মি বাধ্য করছে বলে এক প্রতিবেদনে জানায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটস।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে রাখাইন রাজ্যে উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক সাফল্য অর্জনের পর আরাকান আর্মি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অনেক গ্রামে জোরপূর্বক শ্রম ব্যবস্থা চালু করে। প্রায়ই প্রতিটি পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্যকে, সাধারণত পুরুষদের একদিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত সময়ের জন্য কাজ করতে বাধ্য করে।
রাখাইন থেকে ২০১৭ সালের আগস্টে জান্তার দমন-পীড়নে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় পায়। বর্তমানে সব মিলিয়ে প্রায় ১৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বাস করছে।
জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুন করে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, যখন রাখাইনে সংঘাত চলমান রয়েছে।
রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে প্রতিবেদকের কথা হয় রোহিঙ্গা নুরুল আমিনের সঙ্গে, যিনি গত জুনে মংডুর সিকদার পাড়া থেকে পালিয়ে এসে উখিয়ার ১৮নং ক্যাম্পে আশ্রয় নেন।
নুরুল আমিন মংডুতে অবস্থানরত এক স্বজনের বরাত দিয়ে বলেন, ‘মংডু শহরে আমার চাচাতো ভাই আছে, তার সঙ্গে চার-পাঁচ দিন আগে মোবাইলে কথা হয়েছে। শুনেছি শহরের টাউংপিও লেফটসহ আমাদের পাড়ায় নতুন কিছু ঘর করেছে আরকান আর্মি, যেখানে রাখাইনরা থাকছে এখন। যেগুলো আমাদের বসতভিটা ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কৃষিজমিগুলো তারা নিয়ে নিচ্ছে। সেখানে গুটিকয়েক রোহিঙ্গা রয়েছে, যারা বাধা দিতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।’
আরিফ উল্লাহ নামে আরেক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, ‘আমরা যে বাড়িগুলো রেখে এসেছি সেগুলো এখন অন্যরা দখল নিয়ে থাকছে আরকান আর্মির মাধ্যমে। এটি মেনে নেওয়া যায় না। ওরা আসলে আমাদের অস্তিত্ব মুছে দিতে চাইছে, কিন্তু আমরা তো আজ হোক কাল হোক সেখানে ফিরে যাবো।
২০১৭ সালের পরবর্তীতে মংডুর একটি এলাকায় মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কিছু অভ্যর্থনা ঘর নির্মাণ করেছিল, সেগুলোও বর্তমানে আরকান আর্মি ও তাদের মদদপুষ্ট লোকজন ব্যবহার করছে বলে জানান তারা।
ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের কমিউনিটি সংগঠন ইউনাইটেড কাউন্সিল অফ রোহাংয়ের (ইউসিআর) সভাপতি মাস্টার সৈয়দউল্লাহ বলেন, ‘আরকান আমাদের আদি ভূমি, আমাদের একমাত্র লক্ষ্য প্রত্যাবাসন এবং আমরা অচিরেই ঘরে ফিরব।’
আরকান আর্মি স্বেচ্ছাচারিতা কায়েম করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ওরা আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের বিতাড়িত করে ঘর-বাড়ি দখল নিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে পুরো রাখাইন রোহিঙ্গা শূন্য হয়ে পড়বে। তাই বিশ্বকে আর নীরব থাকা চলবে না, আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে এই সংকট দ্রুত সমাধান করতে হবে।’
রোহিঙ্গা আগমনের ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় জনগণও চান সংকটের সমাধান আসুক। স্থানীয় অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার রবিউল হোসাইন দেশের একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা এই সংকটের টেকসই ও সঠিক সমাধান দেখতে চাই। এমনিতেই স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের কারণে নানা সমস্যার মুখোমুখি, সমাধান না হলে ভবিষ্যতে আমাদের বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে।’
বাংলাদেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় করে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের পথে এগোচ্ছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘প্রত্যাবাসনই এই সংকটের কার্যকরী সমাধান এবং আমরা সে লক্ষ্যে কাজ অব্যাহত রেখেছি। একইসঙ্গে ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও মানবিক সুরক্ষা নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির জান্তা বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু জেলার প্রায় ২৭১ কিলোমিটার এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মি।
এক বছর অতিবাহিত হলেও এখনো রাখাইনে নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন। প্রদেশটির ১৪টি টাউনশিপে (জেলা) নিজেদের দখল রয়েছে এমন দাবি করলেও সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটিতে জান্তার প্রত্যাঘাতের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। গুরুত্বপূর্ণ সিট্যুয়ে, কিয়াকফিউ ও মানাউং—এই ৩টি টাউনশিপ আরকান আর্মির ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেখানে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে জান্তার সামরিক বাহিনী।
ইএ/এসএন