বিমানযোগে কীভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়া হয় মরদেহ। এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে যেসব নিয়ম, ধাপ, কাগজপত্র ও খরচ হয়—যা জানা জরুরি।
সাধারনত মৃত্যুর পর অনেক সময় মরদেহকে দ্রুত এক শহর বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ করে প্রবাসীদের ক্ষেত্রে বিমানই হয়ে ওঠে সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ মাধ্যম। তবে বিমানযোগে মরদেহ পরিবহন কোনো সাধারণ যাত্রা নয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে স্বাস্থ্যবিধি, আইনগত অনুমোদন, আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন এবং এয়ারলাইন্সের নির্দিষ্ট নীতিমালা। কীভাবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, কী কী কাগজপত্র লাগে, কোন ধাপগুলো অনুসরণ করতে হয় এবং আনুমানিক খরচ কেমন—এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো পুরো চিত্র।
কেন বিমানে মরদেহ পরিবহন করা হয়?
দূরত্ব বেশি হলে সড়কপথে বা নৌপথে মরদেহ পরিবহন সময়সাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। সে কারণে দেশে-বিদেশে মরদেহ দ্রুত ও সম্মানজনকভাবে পৌঁছে দিতে বিমান পরিবহন ব্যবস্থাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় “রিপ্যাট্রিয়েশন অব মোর্টাল রিমেইনস”—অর্থাৎ মরদেহ নিজ দেশ বা গন্তব্যে ফেরত পাঠানো।
বিমানযোগে মরদেহ পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি হলো মৃত্যুসনদ (ডেথ সার্টিফিকেট)। এটি অবশ্যই হাসপাতাল বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিতে হয়।
এর পাশাপাশি প্রয়োজন হয়—
•স্থানীয় থানার অনাপত্তিপত্র (পুলিশ ক্লিয়ারেন্স/এনওসি)।
•স্বাস্থ্য বিভাগ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন।
স্বাভাবিক মৃত্যু না হলে বা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে পুলিশি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত মরদেহ পরিবহনের অনুমতি দেয়া হয় না।
এমবাম্বিং: মরদেহ সংরক্ষণের বাধ্যতামূলক ধাপ
বিমানযোগে পরিবহনের আগে প্রায় সব দেশেই মৃতদেহ এমবাম্বিং করা বাধ্যতামূলক। এই প্রক্রিয়ায় বিশেষ রাসায়নিক তরল ব্যবহার করে দেহ সংরক্ষণ করা হয়, যাতে—
•দুর্গন্ধ না ছড়ায়।
•সংক্রমণের ঝুঁকি না থাকে।
•দীর্ঘ সময় নিরাপদে পরিবহন সম্ভব হয়।
এরপর এমবাম্বিং সম্পন্ন হলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা অনুমোদিত সংস্থা থেকে একটি এমবাম্বিং সার্টিফিকেট দেয়া হয়, যা ছাড়া এয়ারলাইন্স মরদেহ গ্রহণ করে না।
কাফিন ও সিলিং: নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি
এমবাম্বিংয়ের পর মরদেহ রাখা হয় বিশেষ ধরনের কাফিনে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী—
•কাফিন হতে হবে শক্ত ও এয়ারটাইট।
•ভেতরে জিঙ্ক বা ধাতব লেয়ার থাকতে হয়।
•বাইরে কাঠের বা ফাইবারের আবরণ দেয়া হয়।
•কাফিন সম্পূর্ণভাবে সিল করা থাকতে হবে।
এই ধাপ শেষে দেয়া হয় কফিন সিলিং বা প্যাকেজিং সার্টিফিকেট।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা
বিমানযোগে মরদেহ পরিবহনের জন্য সাধারণত যেসব নথি প্রয়োজন হয়—
১. মৃত্যুসনদ (ডেথ সার্টিফিকেট)।
২. এমবাম্বিং সার্টিফিকেট।
৩. কফিন সিলিং সার্টিফিকেট।
৪. পুলিশের অনাপত্তিপত্র।
৫. মৃত ব্যক্তির পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি।
৬. গ্রহণকারী ব্যক্তির পরিচয়পত্র।
৭. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দূতাবাস বা কনস্যুলেটের অনুমোদন।
সব নথি সাধারণত ইংরেজিতে হতে হয়, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পরিবহনের ক্ষেত্রে।
এয়ারলাইন্সের নিয়ম: যাত্রী নয়, কার্গো হিসেবে পরিবহন
প্রায় সব এয়ারলাইন্সই মৃতদেহকে যাত্রী হিসেবে নয়, কার্গো (এয়ার কার্গো) হিসেবে পরিবহন করে। এয়ারলাইন্সগুলোর নীতিমালায় সাধারণত বলা থাকে—
•মৃতদেহ আলাদা কার্গো হোল্ডে রাখা হবে।
•নির্দিষ্ট মাপ ও ওজনের কাফিন ব্যবহার করতে হবে।
•সব কাগজপত্র আগে থেকে যাচাই করা বাধ্যতামূলক।
•ফ্লাইট ছাড়ার অন্তত ৩–৪ ঘণ্টা আগে কার্গো টার্মিনালে জমা দিতে হবে।
কিছু এয়ারলাইন্স মানবিক কারণে মৃতদেহ পরিবহনে ছাড় বা বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে, তবে সেটি নির্ভর করে এয়ারলাইন্সের নিজস্ব নীতির ওপর।
বিমানবন্দরে প্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন হয়?
মরদেহ বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর—
১. কার্গো অফিসে সব কাগজপত্র জমা দেয়া হয়।
২. যাচাই শেষে এয়ার ওয়ে বিল তৈরি করা হয়।
৩. নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর কাফিন লোড করা হয়।
৪. ফ্লাইটের কার্গো হোল্ডে সংরক্ষিত অবস্থায় পরিবহন করা হয়।
গন্তব্য বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর একইভাবে কাগজপত্র দেখিয়ে মরদেহ গ্রহণ করতে হয়।
খরচ কত হতে পারে
মৃতদেহ পরিবহনের খরচ নির্ভর করে দূরত্ব, দেশ, এয়ারলাইন্স এবং সার্ভিসের ওপর।
দেশের ভেতরে (ডোমেস্টিক):
•এমবাম্বিং: ৫,০০০–১৫,০০০ টাকা।
•কফিন: ১০,০০০–২৫,০০০ টাকা।
•এয়ার কার্গো বিল: ১০,০০০–৩০,০০০ টাকা।
মোট আনুমানিক খরচ: ৩০,০০০ থেকে ৬০,০০০ টাকা পর্যন্ত।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে:
খরচ অনেক বেশি হয়। সাধারণত ১ লাখ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত যেতে পারে। এতে যুক্ত হয় দূতাবাস ফি, কাস্টমস চার্জ ও অতিরিক্ত কাগজপত্রের খরচ।
শেষ কথা বিমানযোগে মরদেহ পরিবহন একটি সংবেদনশীল ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া। এতে সামান্য ভুল বা কাগজপত্রের ঘাটতি থাকলে পুরো যাত্রাই আটকে যেতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স, হাসপাতাল ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করে সব নিয়ম জেনে নেওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ পথ।
শোকের মুহূর্তে পরিবারের জন্য যেন অতিরিক্ত ভোগান্তি না হয়—সে জন্যই এই পুরো ব্যবস্থাপনা করা হয় নির্দিষ্ট নিয়ম ও সম্মানের সঙ্গে।
এবি/টিকে