অর্থ পাচার:কীভাবে গোটা দেশের অর্থনীতি খালি করে দেয়া হলো,চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের আর্থিক ব্যবস্থা থেকেই ১৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে গেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ হয় এক লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। এ কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তবে অন্যান্য অর্থনীতিবিদের হিসাবে, শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি হতে পারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ হয় ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ৭৯ বিলিয়ন ডলার-এর অর্ধেকের কম।  

প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসে স্থানীয় সময় বুধবার (৪ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাচার হওয়া অর্থের প্রকৃত পরিমাণ কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। বিভিন্ন ধরনের আর্থিক হিসাব-নিকাশ করে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, শেখ হাসিনার টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে তার সহযোগীরা দেশের ব্যাংক খাত থেকে যে পরিমাণ অর্থ লুট করেছে, তা কার্যত পৃথিবীতে আর্থিক কেলেঙ্কারির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এতে দেশের অর্থনীতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, ফোকলা আর ফাঁপা হয়ে গেছে গোটা অর্থ ব্যবস্থা।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সাক্ষাৎকার কবে নেয়া হয়েছে তা নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়নি। তবে চলতি সপ্তাহে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটি বলেছে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে সার্বিকভাবে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে।

আহসান মনসুর নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছিল, লুটপাট করার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে ব্যাংক। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো শত শত কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ দিয়েছে, যে কোম্পানিগুলোর অনেকগুলোর অস্তিত্বই নেই। এই টাকাও কখনো সম্ভবত ব্যাংকে ফিরে আসবে না; এই অর্থের একটি বড় অংশ দেশ থেকে অবৈধভাবে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নির্বাচিত হওয়ার আগে ২৭ বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) কাজ করেছেন আহসান মনসুর। তিনি বলেন, ব্যাংকের পুরো পরিচালনা পর্ষদ হাইজ্যাক করা হয়েছিল। তার ভাষ্য, বিশ্বের অন্য কোনো দেশে সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এভাবে গুন্ডা–মাস্তানদের সহযোগিতায় পুরো ব্যাংক খাতে এমন পদ্ধতিগতভাবে ডাকাতি করেছে, এমন ঘটনা তিনি আর কোথাও দেখেননি।

সংবাদে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে এখনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পালা অব্যাহত রয়েছে, গণসহিংসতাও দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতি প্রসঙ্গে আহসান মনসুর বলেন, আগামী বছর অর্থনীতির আকাশে আরও ঝড় উঠবে; এরপর অর্থনীতির আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করবে।

শেখ হাসিনা ভারতের পালিয়ে গেছেন। তার ভাগ্যে কী আছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, তাঁকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের তদন্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম এহসান। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে এখনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। তবে আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ‘উইচ হান্ট’ করা হচ্ছে, তিনি তার বাইরে নন।

নিউইয়র্ক টাইমস শেখ হাসিনা ও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকায় আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় শূন্য পড়ে আছে। এরপর তারা শেখ হাসিনার মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হয়নি।

ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল মান্নানের পদত্যাগের ঘটনা সবিস্তারে তুলে ধরেছে নিউইয়র্ক টাইমস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি আর দশটা সাধারণ দিনের মতো আব্দুল মান্নান কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। পথিমধ্যে তিনি একটি ফোন কল পান। কলটি করেছিলেন সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরের প্রধান। তাকে বলা হয়, গাড়ির গতিমুখ পরিবর্তন করে তিনি যেন সংস্থাটির সদর দপ্তরে চলে আসেন।

গত অক্টোবর মাসে আব্দুল মান্নান নিউইয়র্ক টাইমসকে সেই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। কার্যালয়ে যাওয়ার পর সামরিক গোয়েন্দারা আব্দুল মান্নানের ফোন, ঘড়ি ও ওয়ালেট রেখে দেন। এরপর গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আব্দুল মান্নানের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের বিবরণ দেন; বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে তিনি যে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন, সে জন্য তার প্রশংসা করেন।

আব্দুল মান্নান ভাবছিলেন, তার সময়টা বোধ হয় বৃথা যাচ্ছে। কিন্তু এরপরই তাকে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগের চিঠিতে সই করতে বলা হয়। গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তাকে বলেন, এই আদেশ দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে এসেছে, অর্থাৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি প্রথমে পদত্যাগ পত্রে সই করতে রাজি হননি। তখন ইসলামের খলিফা ওসমানের কথা মনে হচ্ছিল তার। সপ্তম শতাব্দীতে ঘাতকের আক্রমণের মুখে তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কীভাবে লড়াই চালিয়ে গেছেন।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ইলিয়াসের গায়ে হাত দিলে আমি তারে ছাইড়া দিবো না Sep 19, 2025
img
টেকনাফের গহীন পাহাড়ে বন্দি ৬৬ জনকে উদ্ধার Sep 19, 2025
img
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হেলিকপ্টারের জরুরি অবতরণ Sep 19, 2025
img
রাশিয়ায় ৭.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প, সুনামি সতর্কতা জারি Sep 19, 2025
img
ওয়েলালাগের বাবা আর নেই শুনে ‘সরি’ বললেন নবি Sep 19, 2025
img
ঢাকায় ঝটিকা মিছিলের প্রস্তুতিকালে আ.লীগের ১১ জন গ্রেপ্তার Sep 19, 2025
img
সুপার ফোরে কবে কার বিপক্ষে মাঠে নামবে বাংলাদেশ Sep 19, 2025
img
দুনিথ ওয়েলালাগের বাবা আর নেই Sep 19, 2025
img
আফগানদের হারিয়ে বাংলাদেশকে নিয়েই সুপার ফোরে গেল শ্রীলঙ্কা Sep 19, 2025
img
চবি ভিসি-প্রোভিসির সঙ্গে স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা উপদেষ্টার মতবিনিময় Sep 19, 2025
img
কাশিমপুর থানা আ.লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গ্রেপ্তার Sep 18, 2025
img
জ্যান ফ্রাইলিঙ্কের রেকর্ড ফিফটিতে জিম্বাবুয়েকে হারাল নামিবিয়া Sep 18, 2025
img
ইউরোপে ‘রোহিঙ্গা সংকট’ তুলে ধরার আশ্বাস দিল প্রতিনিধি দল Sep 18, 2025
img
রাবিতে পোষ্য কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল Sep 18, 2025
img
বাংলাদেশ ও চীন হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাবে: প্রধান উপদেষ্টা Sep 18, 2025
নাহিদ ইসলামকে জেরা শেষে যা বললেন আসামি পক্ষের আইনজীবী Sep 18, 2025
img
আসিফ মাহমুদের নতুন এপিএস রাহাত Sep 18, 2025
img
মিথ্যা বলেছিলেন টিউলিপ: দ্য টাইমস Sep 18, 2025
img
প্রথম প্রেম মনে করার দিন আজ Sep 18, 2025
img
হিমাচলে বন্যার্তদের তোপের মুখে কঙ্গনা Sep 18, 2025