ঈদের সময় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া মুসলিম সমাজের বিশেষ সংস্কৃতি। সারা বছর যাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় না ঈদের সময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং তারা পরস্পরের বাড়িতে বেড়াতে আসে। এর মাধ্যমে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা পায় এবং একে অন্যের দুঃখের অংশীদার হয়।ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মীয়-স্বজনের পারস্পরিক যাতায়াত প্রশংসনীয় কাজ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে মুমিন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে এবং তাদের জ্বালাতনে ধৈর্যধারণ করে সে এমন মুমিনের তুলনায় অধিক সাওয়াবের অধিকারী হয়, যে জনগণের সঙ্গে মেলামেশা করে না এবং তাদের জ্বালাতনে ধৈর্য ধারণ করে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪৪৩২)
পারস্পরিক সাক্ষাতের বিধান
আত্মীয়-স্বজনের পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ সাধারণত মুস্তাহাব। চাই তারা সুখে থাকুক বা দুঃখে, সুস্থ থাকুক বা অসুস্থ। কেননা মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় কোনো অসুস্থ লোককে দেখতে যায় অথবা নিজের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে যায়, একজন ঘোষক (ফেরেশতা) তাকে ডেকে বলতে থাকেন, কল্যাণময় তোমার জীবন, কল্যাণময় তোমার এই পথ চলাও।তুমি তো জান্নাতের মধ্যে একটি বাসস্থান নির্দিষ্ট করে নিলে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২০০৮)
আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে কেন যাব?
মুমিন ব্যক্তি অন্যের বাড়িতে বেড়াতে যাবে আল্লাহর নির্দেশ আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অপর ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, তার ব্যাপারে একজন ফেরেশতা আল্লাহর পক্ষ থেকে এই সুসংবাদ পৌঁছায় যে ‘আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসেন, যেমন তুমি তোমার ভাইকে তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ভালোবেসেছ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৪৪৩)
সাক্ষাৎ যখন আবশ্যক
আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ ও সাক্ষাৎ সাধারণ সময়ে মুস্তাহাব।
তবে কখনো কখনো তা আবশ্যক হয়ে যায়। যেমন—
১. মা-বাবার সাক্ষাৎ : মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, নিয়মিত সাক্ষাৎ করা এবং তাদের খোঁজ-খবর রাখা সন্তানের দায়িত্ব। বিশেষত যখন মা-বাবা বার্ধক্যে উপনীত হন অথবা অক্ষম হয়ে পড়েন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন...মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের ‘উফ’ বোলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না; তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বোলো।
’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৩)
২. আত্মীয়তা ছিন্ন হওয়ার ভয় থাকলে : আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয় থাকলে, তা রক্ষার জন্য আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাওয়া আবশ্যক। মহানবী (সা.) বলেন, যখন আল্লাহ সৃষ্টি কাজ সমাধা করার জন্য আত্মীয়তার সম্পর্ককে বলেন, তুমি কি এতে খুশি নও যে তোমার সঙ্গে যে সুসম্পর্ক রাখবে, আমিও তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখব। আর যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৮৭)
৩. অসুস্থ হলে : অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নেওয়া মুমিনের দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, তুমি আমার সেবা-যত্ন করোনি। সে বলবে, হে আমার রব, আমি কিভাবে আপনার সেবা-যত্ন করব অথচ আপনি জগত্গুলোর প্রতিপালক? আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল। অথচ তুমি তার সেবা করোনি। তুমি কি জানো না, যদি তুমি তার সেবা করতে, তবে তার কাছেই আমাকে পেতে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৯)
৪. বিপদগ্রস্ত হলে বা মারা গেলে : কেউ বিপদগ্রস্ত হলে বা মারা গেলে তার পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যাপারে হাদিসে তাগিদ আছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে তার বিপদে সান্ত্বনা দেবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে সম্মানের পোশাক পরাবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬০১)
বিনা প্রয়োজনে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান নয়
কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে, কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে বিনা প্রয়োজনে অবস্থান ও সাক্ষাৎ দীর্ঘ না করাই উত্তম। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের আহবান করলে তোমরা (ঘরে) প্রবেশ কোরো এবং খাওয়া শেষে তোমরা চলে যেয়ো; তোমরা কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না। কেননা তোমাদের এই আচরণ নবীকে পীড়া দেয়, সে তোমাদের উঠিয়ে দিতে সংকোচ বোধ করে। কিন্তু আল্লাহ সত্য বলতে সংকোচ বোধ করেন না।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫৩)
পর্দার বিষয়ে সতর্ক থাকা
আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গেলে অনেক সময় পর্দার বিধান লঙ্ঘন করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘সাবধান! নারীদের কাছে তোমরা প্রবেশ করা পরিত্যাগ কোরো। সে সময় আনসারিদের এক লোক বলল, দেবর সম্পর্কে আপনার কি মত? তিনি বললেন, দেবর তো মৃত্যুতুল্য।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৫৬৭)
উপহার নেওয়া কি আবশ্যক
কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে উপহার নিয়ে যাওয়া উত্তম এবং মেজবানের জন্য সাধ্যানুযায়ী অতিথির যত্ন করা আবশ্যক। এই ক্ষেত্রে ইসলাম লৌকিকতাকে অপছন্দ করে। তাই অতিথি যেমন সাধ্যের চেয়ে বেশি খরচ করে উপহার কিনবে না, মেজবানও আপ্যায়নে সামর্থ্যের চেয়ে অর্থ খরচ করবে না; বরং উভয়ে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী আন্তরিকতার পরিচয় দেবে।
এমআর/এসএন