পাগলা মসজিদে জমা পড়ে কোটি কোটি টাকা, কিন্তু কেন?

কিশোরগঞ্জ শহরের হারুয়া এলাকায় অবস্থিত পাগলা মসজিদটি এ এলাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণ করে আসছে। মসজিদের দানবাক্স খুললেই দেখা যায় কোটি কোটি টাকার স্তূপ। বছরের পর বছর ধরে এ মসজিদে এমন বিপুল পরিমাণ দান জমা পড়ছে, যা অবাক করে দিচ্ছে অনেককেই। পাগলা মসজিদে কেন কোটি কোটি টাকা জমা পড়ে তা নিয়ে মানুষের মনে আগ্রহের শেষ নেই। তাই সিন্দুক খুললেই টাকার অংক জানতে উদগ্রীব হয়ে থাকে মানুষ।

প্রতিদিন দেশ বিদেশের নানান জাত ও ধর্মের মানুষ দান করতে আসে পাগলা মসজিদে। অনেকের ধারণা পাগলা মসজিদে দান করলে মনের আশা পূর্ণ হয়৷ এই মসজিদে শুধু যে মুসলামান ধর্মালম্বীরাই দান করেন তা কিন্তু নয়। প্রায় সব ধর্মাবলম্বী মানুষ নিজের মনের অব্যক্ত বিষয়গুলো চিঠি ও দান করার মাধ্যমে সেখানে প্রকাশ করেন। দানবাক্স খুললেই যার প্রমাণ মিলে। প্রতি তিনমাস পর দান বাক্স খুললেই টাকার সঙ্গে মিলে চিঠি। যেসব চিঠিতে মানুষ তাদের জীবনে প্রাপ্তির আনন্দ, না-পাওয়ার বিরহ বেদনা, আয়-উন্নতির ফরিয়াদ,চাকরির প্রত্যাশা, পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের আশা ও রোগব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে আকুতি প্রকাশ করেন। এসবের জন্যই মানুষ এই মসজিদে এত দান করেন বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ রূপালী ব্যাংকে পাগলা মসজিদের নামে একটি হিসাব রয়েছে। সেখানেই জমা রাখা হয় মসজিদের আয়ের সব টাকা। কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খান জানান, পাগলা মসজিদের একাউন্টে জমা রয়েছে ৮০ কোটি ৭৫ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭৬ টাকা৷

শনিবার (১২ এপ্রিল) ৪ সাস ১২ দিন পর ১১ টি দান সিন্ধুক খোলে ২৮ বস্তা টাকা পাওয়া গিয়েছে। সর্বশেষ দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা পাওয়া গিয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের দানবাক্স খোলা হয় মোট ১১ বার। এই ১১ বারে দানবাক্স থেকেই পাওয়া যায় ৫৬ কোটি ৩৮ লাখ ৫২ হাজার ৬৬০ টাকা। টাকার পাশাপাশি হীরা, বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালংকারও পাওয়া গেছে বিপুল পরিমাণ।

২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বর পাগলা মসজিদের দানবাক্স খুলে রেকর্ড ৮ কোটি ২১ লাখ ৩৪ হাজার ৩০৪ টাকা পাওয়া যায়। এর আগে একই বছরের ১৭ আগস্ট পাগলা মসজিদের দানবাক্স খুলে পাওয়া যায় ৭ কোটি ২২লাখ ১৩ হাজার ৪৬ টাকা। একই বছরের ২০ এপ্রিল পাগলা মসজিদের দানবাক্স খুলে ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৬৭ হাজার ৫৩৭ টাকা পাওয়া যায়। ২০২৪ সালে মোট তিনবারে ২৩ কোটি ২২ লাখ ১৪ হাজার ৮৮৭ টাকা পাওয়া যায়। টাকার পাশাপাশি হীরা, বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণ।

মসজিদ কমপ্লেক্সে প্রতিষ্ঠিত নুরুল কোরআন হাফিজিয়া মাদরাসায় অসহায় পিতৃ-মাতৃহীন শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে। প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা শুধু এ শিক্ষার্থীদের খাবারের পেছনে ব্যয় হয়। শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ভরণপোষণের ব্যয়ও নির্বাহ করা হয় মসজিদের দানবাক্স থেকে পাওয়া অর্থে। প্রতিবছরই মসজিদের অর্থায়নে নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয় তাদের। দানবাক্স থেকে প্রাপ্ত অর্থের লভ্যাংশের একটি বিশেষ অংশ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সহায়তা প্রদানের জন্য অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়।

এই মসজিদটির নাম কেন পাগলা মসজিদ হয়েছে তা নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে। জনশ্রুতি মতে, প্রায় ১৫০ বছর আগে প্রমত্তা নরসুন্দা নদীর পানিতে ধ্যানরত এক ভাসমান দরবেশের আবির্ভাব হয়। তার কল্যাণেই নদীর মধ্যে জেগে ওঠে চর। নদীর তীরবর্তী রাখুয়াইল গ্রামের এক গৃহস্থের গাভি নিয়মিত নদী সাঁতরে ওই দরবেশের ভাণ্ডে ওলানের দুধ দিয়ে আসত। এতেই গাভির দরিদ্র মালিক ও স্থানীয় লোকজনের অনেক বৈষয়িক উন্নতি হয়।

এমন আরো অসংখ্য কেরামতিতে বিমুগ্ধ মানুষজন ওই দরবেশের খেদমতে হুজরাখানা তৈরি করে। দরবেশের মৃত্যুর পর তার হুজরাখানার পাশেই পাগলা সাধকের স্মৃতিতে নির্মিত হয় এই পাগলা মসজিদ।

আরেক জনশ্রুতি হলো-হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির এক নিঃসন্তান নারীকে জনগণ পাগলা বিবি বলে ডাকতেন। এ নারী নরসুন্দার তীরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করলে তা পাগলা বিবির মসজিদ নামে পরিচিতি পায়। এসব জনশ্রুতি ও বিশ্বাস থেকেই মানুষ পাগলা মসজিদে দান করেন বলে জানা গেছে।

১৯৭৯ সাল থেকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে পাগলা মসজিদের কার্যক্রম চলে আসছে। সেই থেকে পদাধিকার বলে পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতির দায়িত্বপালন করেন কিশোরগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক। তার তদারকিতেই হয় মসজিদের অর্থনৈতিক হিসাবনিকাশ। 

এসএম/এসএন

Share this news on: